হজরত ইউসুফ (আ.) এর প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের শিক্ষা

১ সপ্তাহে আগে
আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে নবী ইউসুফ (আ.)-এর জীবনের ঘটনাবলীকে একটি অনন্য শিক্ষণীয় গল্প হিসেবে তুলে ধরেছেন। সুরা ইউসুফে তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আল্লাহ তাআলার পরিকল্পনা, ধৈর্য, ন্যায়পরায়ণতা ও ঈমানদার চরিত্রের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আজকের আলোচ্য আয়াত, সুরা ইউসুফ, আয়াত ৩৬, এ বর্ণিত হয়েছে ইউসুফ (আ.)-এর কারাবাসকালীন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে দুই যুবকের স্বপ্ন এবং ইউসুফ (আ.)-এর প্রজ্ঞা প্রকাশিত হয়।

 

وَدَخَلَ مَعَهُ السِّجْنَ فَتَيَانِ ۖ قَالَ أَحَدُهُمَا إِنِّي أَرَانِي أَعْصِرُ خَمْرًا ۖ وَقَالَ الْآخَرُ إِنِّي أَرَانِي أَحْمِلُ فَوْقَ رَأْسِي خُبْزًا تَأْكُلُ الطَّيْرُ مِنْهُ ۖ نَبِّئْنَا بِتَأْوِيلِهِ ۖ إِنَّا نَرَاكَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ ইউসুফের সাথে আরও দুজন যুবক কারাগারে প্রবেশ করল। তাদের একজন বলল, ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমি মদ নিংড়াচ্ছি।’ অন্যজন বলল, ‘আমি দেখলাম, আমি মাথায় রুটি বহন করছি, এবং পাখি তা থেকে খাচ্ছে। তারা বলল, ‘আমাদেরকে এর ব্যাখ্যা বলে দাও, নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত মনে করি। (সূরা ইউসুফ ১২:৩৬)

 

তাফসির ও প্রেক্ষাপট

 

ইউসুফ (আ.)-কে অন্যায়ভাবে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কারাগারেও তিনি তার চরিত্র, ঈমান এবং সদাচরণের মাধ্যমে সবাইকে মুগ্ধ করেছিলেন। আয়াতে বলা হয়েছে, দুই যুবক ইউসুফ (আ.)-এর সাথে কারাগারে প্রবেশ করেছিল। রেওয়ায়াতে জানা যায়, একজন ছিল বাদশাহর মদ পরিবেশনকারী ও অপরজন ছিল বাবুর্চি। তাদের বিরুদ্ধে রাজাকে বিষ খাওয়ানোর অভিযোগ ওঠে, এবং সেই অভিযোগেই তারা কারারুদ্ধ হয়।

 

আরও পড়ুন: নবীজির প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে মুফতি আবদুল্লাহ তামিমের অনন্য সিরাত গ্রন্থ ‘নবীজির প্রিয় ১০০’

 

কারাগারে ইউসুফ (আ.)-এর সাথে তাদের পরিচয় ঘটে। তার শিষ্টাচার, নৈতিকতা ও ইবাদত দেখে তারা বুঝে ফেলেছিল, এই মানুষটি সাধারণ কেউ নন, তিনি আল্লাহভক্ত ও ন্যায়ের পথের অনুসারী। তাই তারা নিজেদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে তার শরণাপন্ন হয়।

 

স্বপ্নের অর্থ ও ইউসুফ (আ.)-এর জ্ঞান

 

ইউসুফ (আ.) শুধু স্বপ্ন ব্যাখ্যা করতেন না, বরং তিনি ব্যাখ্যার আগে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করতেন। তিনি তাদের বলেছিলেন,

 

তোমরা যাদের উপাসনা করো, তারা নামমাত্র কিছু নাম ছাড়া কিছুই নয়। আসল উপাস্য তো একমাত্র আল্লাহ। (সুরা ইউসুফ: ৩৯-৪০) অর্থাৎ, তিনি স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার পূর্বেই তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছিলেন। এটি নবীসুলভ চরিত্রের উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

 

হাদিসের আলোকে শিক্ষা

 

রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি যেখানে থাকুক, আল্লাহভীতিকে অবলম্বন করো। (তিরমিযি: ১৯৮৭)

 

ইউসুফ (আ) ছিলেন এমন এক উদাহরণ, যিনি কারাগারের অন্ধকারেও আল্লাহভীতি ও নৈতিকতার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। কারাগারে থেকেও তিনি দাওয়াতের কাজ, দয়া, সহমর্মিতা ও ঈমানের দৃঢ়তা বজায় রেখেছিলেন।

 

আরেকটি হাদিস বলা হয়েছে,

 

যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য ধরবে, আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন। (বুখারি: ১৪৬৯)

 

ইউসুফ (আ.) ধৈর্যের প্রতীক হয়ে ইতিহাসে অমর হয়েছেন। অন্যায় অভিযোগ, দাসত্ব, কারাবাস, সব কিছুর পরেও তার মুখে কোনো অভিযোগ ছিল না, বরং ছিল আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা।

 

নৈতিক শিক্ষা ও বার্তা

 

১. অন্যায়ের শিকার হলেও ন্যায়চ্যুত হওয়া উচিত নয়। ২. সৎকর্ম ও নৈতিকতা মানুষকে সম্মান এনে দেয়, কারাগারের মতো জায়গাতেও। ৩. প্রতিটি বিপদের পেছনে আল্লাহর পরিকল্পনা লুকিয়ে থাকে। ৪. মানুষের আস্থা অর্জনের সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে নৈতিক চরিত্র। ৫. ইউসুফ (আ.)-এর জীবন শেখায়, দাওয়াতের সুযোগ যেখানেই থাকুক, তা কাজে লাগানো উচিত।

 

সুরা ইউসুফের এই আয়াত আমাদের শেখায়, জীবনের প্রতিটি পর্বে আল্লাহর পরিকল্পনা আছে। ইউসুফ (আ.)-এর কারাবাস ছিল এক দুঃখজনক অধ্যায়, কিন্তু সেই কারাগারই পরিণত হয়েছিল তাঁর দাওয়াত ও প্রজ্ঞার মঞ্চে। তিনি ধৈর্য, ন্যায় ও ইমানের যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, তা আজও প্রতিটি মুমিনের জন্য পথপ্রদর্শক। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে ইউসুফ (আ.)-এর মতো ধৈর্যশীল, ন্যায়পরায়ণ ও ঈমানদার বানান।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন