ঘুরে আসতে পারেন সময়ের গহীন থেকে উঠে আসা ইতিহাসের এই জীবন্ত নিদর্শনে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, খ্রিস্টীয় সপ্তম বা অষ্টম শতকে নির্মিত হয়েছিল এই বিশাল স্থাপনাটি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মচর্চা ও সন্ন্যাসীদের বসবাসের কেন্দ্র হিসেবেই ব্যবহৃত হতো এটি। ১৯৮৪ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এখানে প্রথম খনন কাজ শুরু করে। অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে উন্মোচিত হয় হারানো এক সভ্যতার চিহ্ন ৯৪টি প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট বিশাল মন্দির কাঠামো। ইটের কারুকাজ, টেরাকোটার অলংকরণ এবং বৃত্তাকার প্রকোষ্ঠগুলো আজও দক্ষিণবঙ্গের প্রাচীন স্থাপত্য ঐতিহ্যের অনন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
খননে পাওয়া পোড়ামাটির ফলক, প্রদীপ, মূর্তির ভগ্নাংশ ও নকশাকৃত ইট প্রমাণ করে—এটি কেবল ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং প্রাচীন নগর পরিকল্পনার এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, প্রাচীন কালের রাজা ভরত এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, যার নামানুসারে স্থানটির নাম ‘ভরত ভায়না’।
দর্শনার্থীরা বলেন, এখানে এসে মনে হয় যেন সময় থমকে গেছে। খুলনা থেকে ঘুরতে আসা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন,প্রাচীন ইটের প্রতিটি দাগ যেন ইতিহাসের গল্প বলে। জায়গাটা এত নিরিবিলি ও প্রাচীন যে মনে হয় হাজার বছর আগের পৃথিবীতে ফিরে গেছি। আরেক দর্শনার্থী যশোরের সাবরিনা আক্তার বলেন, বৌদ্ধ ধর্মীয় ঐতিহ্যের এমন নিদর্শন দক্ষিণাঞ্চলে খুব কমই আছে। প্রতিটি প্রকোষ্ঠে লুকিয়ে আছে এক অজানা রহস্য।
কীভাবে যাবেন
ভরত ভায়না খুলনা ও যশোরের মাঝামাঝি কেশবপুর উপজেলার গৌরিঘোনা ইউনিয়নে, বুড়িভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। খুলনা থেকে সাতক্ষীরা মহাসড়ক ধরে চুকনগর পর্যন্ত গিয়ে ডান পাশে গ্রামীণ সড়ক ধরে গেলে চোখে পড়বে ঐতিহাসিক এ স্থাপনা। আবার খুলনার দৌলতপুর হয়ে ডুমুরিয়া শাহপুর হয়ে মিকশিমিল গ্রাম পার হয়েও যাওয়া যায় সহজেই। খুলনা থেকে দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার, আর যশোর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। স্থানীয় বাস, মোটরসাইকেল বা অটোরিকশায় সহজেই পৌঁছানো যায় গন্তব্যে। দর্শনার্থীদের জন্য মঙ্গলবার থেকে শনিবার সকাল ১০টা থেকে খোলা থাকে স্থানটি, আর সোমবার দুপুর দেড়টার পরেও দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারেন। রোববার দিনটি সাপ্তাহিক বন্ধ।
সীমাবদ্ধতা
ভরত ভায়না খুলনা-যশোর তথা দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলেও পর্যটন ব্যবস্থাপনায় রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। প্রত্নস্থলে যাওয়ার রাস্তা সরু ও খানাখন্দে ভরা। পার্কিংয়ের জায়গা নেই, ভেতরে নেই কোনো বিশ্রামাগার বা ছায়াযুক্ত বসার ব্যবস্থা। কাছাকাছি আবাসনের সুযোগও খুব সীমিত, ফলে দূর থেকে আসা দর্শনার্থীদের দিনের মধ্যেই ফিরে যেতে হয়।
দর্শনার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জায়গাটা অসাধারণ, কিন্তু রাস্তা ও অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়ায় অনেকে আসতে পারেন না। প্রচার-প্রচারণা বাড়ালে এটি খুলনা বিভাগের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হতে পারত।’
বরিশাল থেকে খুলনায় আসেন আরেক দর্শনার্থী হাবিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক দিন ধরে এই স্থাপনায় আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আসতে যে কষ্ট হয়েছে আবার আসবো কি না বলতে পারছি না। এখানে গাড়ী পার্কিংয়ের কোন ব্যবস্থা নেই, বিশ্রামের ব্যবস্থা নেই। আবাসানের সুযোগ নেই, আর সড়ক পথের খুবই বেহাল দশা। এসব বিষয়ের উন্নয়ন করা গেলে এখানে দর্শনার্থী বাড়বে।’
কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা
যদিও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, ধীরে ধীরে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, ভরত ভায়না একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান। এর ইতিহাস সংরক্ষণ ও পর্যটন সম্ভাবনা বৃদ্ধিতে আমরা ইতোমধ্যে সড়ক সংস্কার, তথ্যকেন্দ্র স্থাপন ও দর্শনার্থী সুবিধা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। তবে এটা আমাদের দপ্তরের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়। আমরা চেষ্টা করছি সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান, প্রচার বৃদ্ধির ব্যবস্থা করার।
খুলনা ও যশোর অঞ্চলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় বর্তমানে ১৮টি প্রত্ননিদর্শন রয়েছে, আর পুরো খুলনা বিভাগে সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে ভরত ভায়না এখনো সবচেয়ে বড় ও রহস্যময় বৌদ্ধ স্থাপনাগুলোর একটিযা সময়, সভ্যতা আর সংস্কৃতির এক অমূল্য দলিল হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।