সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বাংলাদেশে নতুন করে দমন-পীড়ন, এইচআরডব্লিউ’র উদ্বেগ

১৯ ঘন্টা আগে
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকদের গ্রেফতারে সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ব্যবহার বাড়াচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

 

এইচআরডব্লিউ বলেছে, বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার দলের উচিত নির্বিচারে আটক ব্যক্তিদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানানো এবং মানবাধিকার রক্ষা ও রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করতে কর্তৃপক্ষকে উৎসাহিত করা।

 

প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন সপ্তাহের বিক্ষোভের মুখে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। ওই বিক্ষোভে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি হয়। চলতি বছরের ১২ মে অন্তর্বর্তী সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম  সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করে। দলটির সমর্থনে যেকোনো সভা, প্রকাশনা ও অনলাইনে বক্তব্য দেয়াও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এইচআরডব্লিউর অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সদস্য ও শান্তিপূর্ণ অধিকারকর্মীদের গ্রেফতারে আইনটি ব্যবহার করা হচ্ছে।


যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারাগারে পুরে দেয়া কিংবা শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশে বাধা দেয়ার মতো পক্ষপাতমূলক আচরণ অন্তর্বর্তী সরকারের করা উচিত নয়। তাহলে শেখ হাসিনার সরকারের সময় বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে যা করা হয়েছে, তার সঙ্গে কোনো পার্থক্য থাকল না।

 

তিনি আরও বলেন, সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরকে বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় সহায়তার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাদের উচিত সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নজরদারি করা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেফতারের ঘটনাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করা।

 

আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাসহ ৩০ জনের গ্রেফতারি পরোয়ানা গেল ১২ দফতরে

 

এইচআরডব্লিউর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। অসংখ্য ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক রাখা হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করাসহ পুলিশ হেফাজতে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন।

 

গত ২৮ আগস্ট ‘মঞ্চ ৭১’ নামের একটি সংগঠনের আয়োজিত আলোচনা সভা থেকে সাংবাদিক, শিক্ষাবিদসহ ১৬ জনকে আটক করে পুলিশ। রাজধানীতে সাংবাদিকদের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) কার্যালয়ে প্রকাশ্যে ওই সভার আয়োজন করা হয়েছিল। হঠাৎ একদল ব্যক্তি সেখানে গিয়ে সভায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ঘিরে ফেলেন এবং তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করেন। সভায় উপস্থিত ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের অনুগত বলেও অভিযোগ করেন তারা।

 

ওই সভায় অংশ নিয়েছিলেন সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না। তিনি নিরাপত্তার জন্য পুলিশকে ফোন করেন। কিন্তু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের গ্রেফতারের বদলে পুলিশ আলোচনা সভায় অংশ নেয়া ১৬ জনকে আটক করে। এর মধ্যে কয়েকজনের বয়স ছিল ৭০ থেকে ৮০ বছর। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, যিনি পরে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন।

 

প্রাথমিকভাবে পুলিশ পরিবার ও আইনজীবীদের জানিয়েছিল, নিরাপত্তার জন্য তাদের আটক করা হয়েছে। পরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। এবং একই মামলায় আরও দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের অভিযোগে দাবি করা হয়, গ্রেফতার ব্যক্তিরা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিয়েছেন।

 

গত ৪ সেপ্টেম্বর জামিন শুনানির সময় মঞ্জুরুল আলম পান্নাকে হেলমেট, হাতকড়া ও বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরিয়ে আদালতে আনা হয়। সে সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা অন্য এক সাংবাদিকের ওপর হামলা চালান। গ্রেফতার এক ব্যক্তির পরিবারের একজন সদস্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, এমনকি এটি কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানও ছিল না। এটি ছিল একটি আলোচনা সভা। তাহলে এটিকে কীভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করা হবে?

 

ওই ব্যক্তি আরও বলেন, "এসব মানুষ কারাগারে আছেন। কিন্তু যারা তাদের ওপর হামলা চালিয়েছেন, তারা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ সরকারকে ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই মনে হচ্ছে"।

 

আরও পড়ুন: আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল কমেছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

 

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়। কর্মকর্তারা বলেছেন, ক্ষমতায় থাকাকালে এই আইনের অপব্যবহারের জন্য আওয়ামী লীগের সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় আনতে ২০২৫ সালের সংশোধনী দরকার ছিল।

 

শান্তিপূর্ণ বক্তব্য ও সমাবেশের অধিকার দমন করা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরিপন্থি। বাংলাদেশ এডিটরস কাউন্সিল সতর্ক করেছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংশোধনগুলো মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবে, যা উদ্বেগজনক। এটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও ড. মুহাম্মদ ইউনূস মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

 

সরকার রক্ষণশীল মুসলিমদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। গোষ্ঠীগুলো তাদের দাবি আদায় করতে গিয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের আইন সহায়তা এবং মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতার (মব) হামলায় অন্তত ১৫২ জন নিহত হয়েছেন।

 

একজন রাজনৈতিক কর্মী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, ‘হয়তো সন্ত্রাসী হিসেবে কারাগারে থাকা, নয়তো উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলার শিকার হওয়া-এ ছাড়া এখন আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। আমি বলছি না যে দোষীদের শাস্তি হওয়ার দরকার নেই। তবে এটি হতে হবে একটি নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার অধীনে, যা দিতে ইউনূস সরকার ব্যর্থ হয়েছে।’

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন