স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, বাসাবাড়ির বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানিতে বংশ বিস্তার করছে এডিস মশা, ছড়াচ্ছে রোগবালাই। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ টিম পরীক্ষা করে মাদারীপুর পৌরসভাকে ডেঙ্গুর রেডজোন এলাকা ঘোষণা করলেও সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
তিন বছরের মেয়ে নাফিজার জ্বর হলে মাদারীপুর জেলার সবচেয়ে বড় হাসপাতালে নিয়ে আসেন মোস্তফাপুরের বাসিন্দা লিপি আক্তার। পরীক্ষা শেষে ধরা পড়ে ডেঙ্গু। টানা সাতদিনেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি পরিস্থিতি।
সদর উপজেলার মোস্তফাপুরের বাসিন্দা লিপি আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়ের হঠাৎ জ্বর আসে। সাতদিনেও জ্বর কমেনি। তারপর সদর হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখানে এসে পরীক্ষা শেষে জানতে পারি, ডেঙ্গু হয়েছে। এর কয়দিন আগে আমার বাড়ির কাছেও এক শিশুর ডেঙ্গু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভয় লাগছে।’
একই অবস্থা ভদ্রখোলা থেকে আসা ১৪ বছরের মামুন ও ঘোষেরহাটের ব্যবসায়ী বজলুর রহমানেরও। শরীরের প্রচণ্ড জ্বর, তার সঙ্গে কাপুনী, মাথা ব্যথা নিয়ে ছুটে আসেন ২৫০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতালে।
সদর উপজেলার ভদ্রখোলা থেকে আসা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী মামুনের মা মাকসুদা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের ডেঙ্গু হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছি, হাসপাতাল থেকে মশারি দেয়নি। আমাদেরও বাড়িতে থেকে মশারি আনতে মনে নেই। শুধু আমার ছেলেকেই নয়, কোনো রোগীকেই মশারি দেয়নি।’
আরও পড়ুন: ডেঙ্গুতে আরও ৭ জনের মৃত্যু
ডাসার উপজেলার ঘোষেরহাটের মুদি ব্যবসায়ী বজলুর রহমান বলেন, ‘হঠাৎ মাথা ব্যথা, এর সঙ্গে জ্বর। শুরু হয় কাঁপুনি। এরপর শরীর দুর্বল হয়ে যায়। পরে পরিবারের লোকজন জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। পরীক্ষা করালে ধরা পড়ে ডেঙ্গু। এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে যাই। সাতদিন ধরে হাসপাতালে আমি ও অন্য রোগীরা ভর্তি রয়েছে।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে নতুন নতুন রোগী। চিকিৎসা নিতে আসা ভর্তি হওয়া রোগীরা মশারি ব্যবহার করছেন না। মানছেন না নিয়মকানুনও। রয়েছে নানান অজুহাতও।
এদিকে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীকে কামড় দেয়া মশা থেকে এই রোগ দ্রুত অন্যদের শরীরে ছড়াতে পারে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। বাসা-বাড়ির আঙিনায় জমে থাকা পানি, বদ্ধ ড্রেনে মশার উপদ্রব বেশি হচ্ছে বলে দাবি সিভিল সার্জনের।
আর পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও ওষুধ ছিটানোসহ নানান কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা।
মাদারীপুর ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি) ডা. মোহাম্মদ ভূঁইয়া আব্দুস সামাদ আজাদ বলেন, ‘ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের বেশির ভাগ রোগীই স্বাস্থ্য সচেতন নন। নিজেদের মত করে রোগীরা থাকেন। এমনকি মশারি ব্যবহারেও অনীহা অনেক রোগীর। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের কামড় দেয়া মশা থেকে এই রোগী অন্যদেরও শরীরে দ্রুত ছড়াতে পারে। এজন্য মশারি ব্যবহার জরুরি। এছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুতেই কমবে না।’
মাদারীপুরের সিভিল সার্জন ও মাদারীপুর ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মুনীর আহম্মেদ খান জানান, বর্ষা মৌসুম শেষ হলেও মাদারীপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার বেড়েই চলছে। এর অন্যতম কারণ হলো, বাসা-বাড়ির আঙিনায় জমে থাকা পানি থেকে এডিস মশার উপদ্রব হচ্ছে। এছাড়া ফুলের টব, গাড়ির অপ্রয়োজনীয় টায়ার, বন্ধ এসি ও অব্যবহৃত বাথরুমের কমোডে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে। এর থেকে বাঁচতে নিয়মিত জমে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে।
আরও পড়ুন: শিশুর ঠান্ডাজনিত রোগ ও জ্বর হলে করণীয়
এছাড়া এ রোগের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিতে হবে বলে জানান এ চিকিৎসক।
মাদারীপুর পৌরসভার সচিব খন্দকার আবু আহম্মেদ ফিরোজ ইলিয়াস জানান, গত ৫ মাস ধরে মাদারীপুর পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত এডিস মশা নিধনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও ওষুধ ছিটানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়মিতই নেয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর মাদারীপুর পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা এডিস মশার রেডজোন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেই হিসেবে এডিস মশা নিধনে এই কার্যক্রম সারাবছরই চলবে। এডিস মশা নিধনের জন্য আরও ওষুধ ক্রয়ের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
চলতি বছর জেলায় এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর ১২০০ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে সদর উপজেলায়ই রয়েছে অর্ধেক। বর্ষা মৌসুম শেষ হলেও মাদারীপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। এ রোগের উপসর্গ দেখা দিলে ভয় আর আতঙ্ক নয়, দ্রুত হাসপাতালে আসা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার কথা বলছে স্বাস্থ্য বিভাগ।