ব্রজেন্দ্রর উদ্ভাবিত বারোমাসি গ্রাফটিং টমেটো চারা যাচ্ছে সারা দেশে

১ সপ্তাহে আগে
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার তিলকপুর গ্রামের একজন কৃষি উদ্যোক্তা ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ। তিনি পয়ত্রিশ বছর আগে নিজ উদ্যোগে বন-বেগুনের সাথে টমেটোর গ্রাফটিং পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করেছিলেন। প্রথমবারেই তিনি বাজিমাত করেন বারোমাসি এ টমেটো চারা উৎপাদনে।

তারপরে বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদনের যাত্রা শুরু করেন। ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহের দেখাদেখি খুব অল্প সময়ে পুরো জেলায় তার উদ্ভাবিত টমেটো চারার চাহিদা বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে টমেটোর উৎপাদনও হয় ভালো। এত দিনে, তার এ উদ্ভাবিত গ্রাফটিং পদ্ধতির টমেটো চারা পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। শীতের এ সবজি এখন সব ঋতুতেই উৎপাদন সম্ভব। 


ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহের উদ্ভাবিত এ টমেটোর চারাকে এখন মৌলভীবাজার জেলার ‘আইকন’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ মূলত একজন কৃষক। বাড়ির ফসলি জমিতে অন্যান্য ফসলাদি চাষাবাদের পাশাপাশি প্রতি শীত মৌসুমে টমেটোরও চাষাবাদ করতেন। এতে দেখা যায়, কোনো না কোনো কারণে টমেটোর ফলনে বিপর্যয় ঘটে। একই সঙ্গে ঝড়-বৃষ্টিতে গাছ হেলে গোড়ায় পানি আটকে মারা যায়। প্রতি বছরই এ রকম ক্ষয়ক্ষতি নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়।  


এ থেকে উত্তোরণের পথ কী হয় এনিয়ে ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ ভাবতে থাকেন। যেমন চিন্তা তেমনই কাজ। ১৯৯০ সালের কথা। ড. মোহাম্মদ আলী নামে এক সম্পাদকের মাসিক পত্রিকা থেকে টমেটো গ্রাফটিং বিষয়ে তথ্য নিয়ে তিনি গ্রাফটিং পদ্ধতিতে টমেটো চারা উদ্ভাবনের চেষ্টা শুরু করেন। টানা দুই বছর এ বিষয়ে গবেষণা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে এসে গ্রামের পথের পাশে অবহেলায় পড়ে থাকা জংলী বনবেগুন নিয়ে গবেষণায় নামেন। এতে তিনি গবেষণায় সফলতাও পান। বনবেগুনের সঙ্গে বিশেষ কায়দায় গ্রাফটিং করে টেমেটোর চারা তৈরি করেন। 


আরও পড়ুন:  নাটোরে পাটের বাম্পার ফলন, ভালো দাম পেয়ে খুশি চাষিরা


দেখা যায়, তারই উদ্ভাবিত টমেটোর গ্রাফটিং চারা রোপণ করে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতেই টমেটোর ফলন পাওয়া যায়। শুধু তাইনা- এ চারার বৈশিষ্ট্য হল ভারি বর্ষণে চারার কোনো ক্ষতি হয় না। এমনকি রোপণকৃত গাছ হেলে পড়ে না। এক কথায় বলা যায়, পানি সহনীয় গাছ। তাছাড়া সব ঋতুতেই সারাবছরই চাষ করে ফলন পাওয়া যায় ভালো। সাধারণত একটি টমেটো গাছ থেকে ৩ থেকে ৪ কেজি ফলন হয়ে থাকে। তবে ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহের উদ্ভাবিত এ টমেটো চারার গাছ থেকে ৭ থেকে ৮ কেজির ফলন আসে। 


আবার এও দেখা গেছে, কোন কোন গাছে ১০ থেকে ১২ কেজিও ফলন পাওয়া গেছে। শুরুতেই গ্রাফটিং এ পদ্ধতির চারায়, কমলগঞ্জের তিলকপুর গ্রামের চাষি ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহের, অভাবনীয় সাফল্য দেখা দেয়। এতে মণিপুরী অধ্যুষিত এলাকার এ গ্রামের অন্য চাষিদের মধ্যে একরকম হৈচৈ পড়ে যায়। ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহের দেখাদেখিতে, মণিপুরী অন্যচাষিরাও গ্রাফটিং পদ্ধতিতে চারা নিয়ে টমেটো চাষ শুরু করেন। প্রথম দিকে মাত্র ৫ জন এ পদ্ধতির টমেটো চাষ করেন। তবে কিছু দিনের ব্যবধানেই পুরো কমলগঞ্জ উপজেলায় গ্রাফটিং পদ্ধতির এ টমেটো চাষ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে পুরো জেলায় প্রায় তিন শো চাষি শুধুমাত্র চারা উৎপাদনের সাথে জড়িত রয়েছেন। এছাড়া, আড়াই হাজার শ্রমিক এ কাজের সাথে জড়িত।

 

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, সারাবছর জুড়েই, শুধু চারা বিক্রি থেকেই আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার, আয় হচ্ছে। অনেক চাষিই এখন স্বচ্ছল হয়ে উঠেছেন। 

 

কৃষি বিভাগ বলছে, ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহের উদ্ভাবিত গ্রাফটিং পদ্ধতির টমেটোর চারা এখন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। গেল বছর, আটচল্লিশ লাখ টমেটোর চারা উৎপাদন হয়। এবছর ৫৫ লাখ চারা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এক একটি গ্রাফটিং টমেটোর চারা ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 


আরও পড়ুন: সোনালি আঁশ ঘিরে স্বপ্ন বুনছেন পঞ্চগড়ের চাষিরা


সরেজমিনে কমলগঞ্জের তিলকপুর গ্রামে গেলে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ জুড়ে শুধুই পলিথিন মোড়ানো সেড। আর সেডের নিচে লাখ লাখ গ্রাফটিংয়ের টমেটোর চারা। দূর দূরান্তের জেলা থেকে ক্রেতারা আসছেন চারা কিনে নিতে। সেই সাথে পুরো উপজেলার মাঠ জুড়ে টমেটোর চাষাবাদ। কথা হয় তিলকপুর গ্রামের লাইমরাকোনার কাশেম আলী ও আনোয়ার হোসেনসহ একাধিক চাষির সাথে। 

 

তারা জানালেন, এ গ্রামের শতভাগ লোক প্রায় বিশ বছর ধরে টমেটো গ্রাফটিং করে আসছেন। চারা তৈরি করে বিক্রিতে প্রত্যেকেই তারা লাভবান। আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা পেয়েছেন। 

 

মাধবপুর ইউনিয়নের শুকুর উল্লাহ গ্রামের মো. আবদুল মান্নান জানালেন, তিনি নয় বছর ধরে টমেটো চাষাবাদ করছেন। গ্রাফটিং চারা দিয়ে ১৫ শতক জমিতে চাষ শুরু করেন। ভালো ফলন পাওয়াতে একে একে চাষাবাদ বাড়াতে থাকেন। বর্তমানে ১৩ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছেন। আশা করছেন কম করে হলে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টাকার টমেটো বিক্রি করবেন। একইভাবে কমলগঞ্জ উপজেলার অনেক চাষি ভালো ফলনের আশা করছেন। 

 

কমলগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার রায় জানান, ব্রজেন্দ্র বাবুর উদ্ভাবিত গ্রাফটিং টমেটো এ উপজেলার কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ। 


আরও পড়ুন: চিংড়ি শিল্পে নতুন সম্ভাবনা: আশার আলো দেখাচ্ছে রামপুরা চিংড়ি এস্টেট


মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জালাল উদ্দিন জানান, জেলার চাহিদা মিটিয়ে এখন কমলগঞ্জের বারোমাসি গ্রাফটিং টমেটো চারা সারাদেশে সরবরাহ হচ্ছে। এটি এখন এ জেলার একটি আইকন বলা যায়।  কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্য মতে এ বছর জেলায় গ্রাফটিং পদ্ধতির টমেটো ১৮০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৫ হাজার ৪ শো মেট্রিক টন।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন