টানা ছুটি, ঈদের ছুটি কিংবা সপ্তাহান্তে বান্দরবান হয়ে ওঠে পর্যটকদের মিলনমেলা। আবার অনেকেই শুধু প্রকৃতির টানে সারা বছর ছুটে আসেন এখানে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত এই জেলা যেন ভ্রমণপিপাসুদের জন্য স্বর্গীয় আশীর্বাদ। চলুন জেনে নিই বান্দরবানের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলো সম্পর্কে-
নীলাচল: মেঘের রাজ্য
বান্দরবান শহর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে লুকিয়ে আছে নীলাচল। বর্ষার দিনে পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ এসে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। প্রতিটি মেঘের ফাঁকে শহরের রঙিন জীবন যেন ম্লান হয়ে মিশে যায় প্রকৃতির শান্তিতে। এখানকার পাহাড়ি হাওয়ায় হাঁসফাঁস করা শহরের ক্লান্তি দূর হয়, আর চোখের সামনে যেন বিস্তৃত সবুজের সুরভি নাচে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, নীলাচলের মেঘ শান্তি এবং সৌভাগ্যের প্রতীক।
নীলাচলের সৌন্দর্যের প্রধান আকর্ষণ হলো মেঘের ছোঁয়া। বর্ষাকালে মনে হবে যেন আপনি হেঁটে যাচ্ছেন মেঘের ভেতর দিয়ে। কখনো মেঘ এসে ঢেকে দেয় চারপাশ, আবার কখনো এক নিমিষে সরে গিয়ে চোখের সামনে খুলে দেয় অসীম আকাশ আর অসংখ্য সবুজ পাহাড়ের দৃশ্যপট। শীতকালে ভোরে বা সন্ধ্যার সময় এখানকার কুয়াশা আর পাহাড়ি হাওয়া পর্যটকদের মনে অন্যরকম আবেশ জাগায়।
নীলাচল থেকে বান্দরবান শহরকে একেবারে পাখির চোখে দেখা যায়। দিনের বেলায় শহরের ব্যস্ততা আর নদীর বাঁক স্পষ্ট দেখা গেলেও রাত নামলে অসংখ্য আলো জ্বলজ্বল করে উঠে তারার মতো। শহরকে এভাবে উঁচু থেকে দেখার অভিজ্ঞতা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকে।

যাতায়াত: জেলা শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নীলাচল। তাই যাতায়াতও একেবারেই সহজ। মোটরসাইকেল, সিএনজি, মাহিন্দ্র, থ্রি হুইলার, চাঁদের গাড়ি কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি- সব মাধ্যমেই যাওয়া যায়। শহর থেকে নীলাচল পৌঁছাতে সময় লাগে গড়ে ১৫ মিনিট। ভাড়াও খুব বেশি নয়- সিএনজিতে প্রায় ৪০০ টাকা, চাঁদের গাড়িতে ৬০০ টাকা। জেলাপ্রশাসন পরিচালিত এ পর্যটন কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পর্যটকদের ৫০ টাকা ফি দিতে হয়। প্রশাসনের নজর দারিতে থাকায় এ পর্যটন স্পটটি পর্যটকদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রে প্রবেশ ও অবস্থান করতে পারে পর্যটকরা।
থাকার ব্যবস্থা: নীলাচল শুধু দিনের বেলায় নয়, রাতের বেলাতেও সমান আকর্ষণীয়। এখানে রয়েছে উঁচু পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বানানো সুন্দর কটেজ, যেখানে বুকিং দিয়ে রাত কাটানো যায়। প্রতিটি ডাবল বেডের কটেজ ভাড়া মাত্র ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে। রাতে পাহাড়ের নির্জনতা, তারাভরা আকাশ আর দূরে ঝিলমিল করা শহরের আলো মিলেমিশে যে পরিবেশ তৈরি করে, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সকালে ঘুম ভাঙবে পাখির ডাক আর পাহাড়ি বাতাসে, জানালা খুলতেই চোখে পড়বে মেঘের সমারোহ।
আরও পড়ুন: এই বর্ষায় ঘুরে আসুন রাঙ্গামাটি
মেঘলা: পাহাড় ও লেকের মিলনমেলা
নীলাচলের পরেই মেঘলা, পাহাড়ের কোলে টলটলে স্বচ্ছ লেক। লেকের জলে প্রতিফলিত হয় চারপাশের সবুজ আর আকাশের নীল, যেন প্রকৃতির আঁকা এক ক্যানভাস। লেকের উপর দিয়ে ঝুলন্ত সেতু, ক্যাবল কারে লেকের অপর প্রান্তে যাত্রা, সবই ভ্রমণকে আনন্দময় করে তোলে। স্থানীয় মানুষের গল্প, তাদের হাসি আর হাটবাজারের শব্দের সঙ্গে লেকের শান্তি যেন মিশে যায়। শিক্ষার্থী, গার্মেন্টস কর্মী বা দূর দূরান্ত থেকে আসা পর্যটক- সবারই পছন্দের গন্তব্য মেঘলা।
শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ নয়নাভিরাম স্পটটি যেন পাহাড় আর লেকের এক অনন্য সমাহার। চারপাশে সবুজে মোড়া উঁচুনিচু পাহাড় আর মাঝখানে স্বচ্ছ পানির লেককে ঘিরেই গড়ে উঠেছে মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স। জেলাপ্রশাসন পরিচালিত এ পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ করতে জনপ্রতি ৫০ টাকা ফি দিতে হয়।
এখানে বিনোদনের জন্য রয়েছে নানা আয়োজন। লেকের উপর দুইটি ঝুলন্ত সেতু, যা পর্যটকদের কাছে ভীষণ আকর্ষণীয়। শুধু তাই নয়, রয়েছে ক্যাবল কারে চড়ে লেকের এপার থেকে ওপার যাওয়ার সুযোগ, যার জন্য গুনতে হবে মাত্র ১০০ টাকা। পাশাপাশি লেকের স্বচ্ছ পানিতে প্যাডেল বোট নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে পুরো বান্দরবানের ঢেউ খেলানো দৃশ্য একনজরে উপভোগ করা যায় এখান থেকে। আর সবুজ বনের ভেতর ঘুরে বেড়ালে প্রকৃতির সাথে যেন আরও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়।

যাতায়াত: শহর থেকে মেঘলায় পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট। যেহেতু পর্যটনকেন্দ্রটি শহরের একেবারে কাছেই, তাই যাতায়াত ব্যবস্থাও বেশ সহজ। চাঁদের গাড়িতে যাওয়া যায় ৫০০ টাকায়, সিএনজি মাহিন্দ্র নিলে খরচ হয় প্রায় ২০০ টাকা। গণপরিবহনে জনপ্রতি ভাড়া মাত্র ১০ টাকা। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ি বা ভাড়া গাড়িতেও খুব সহজেই যাওয়া যায় মেঘলায়।
থাকার ব্যবস্থা: মেঘলা শুধু দিনের ভ্রমণের জন্যই নয়, রাত কাটানোর জন্যও আকর্ষণীয় স্থান। এখানে রয়েছে লেকপাড়ে নির্মিত চমৎকার গেস্ট হাউস, যেখানে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। জেলাপ্রশাসনের অনুমতি নিয়ে নামমাত্র মূল্যে বুকিং দেওয়া যায় এই গেস্ট হাউসে। লেকপাড়ের নিরিবিলি পরিবেশে রাত কাটানো পর্যটকদের জন্য হয়ে উঠতে পারে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন জল-পাহাড়-আকাশের মিলনমেলা ‘মাধবপুর লেক’ থেকে
প্রান্তিক লেক: পাহাড়-অরণ্যের বুকে নির্জনতার স্বর্গ
বান্দরবানের পর্যটন মানচিত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে প্রান্তিক লেক। প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এটি এখন এক অনন্য গন্তব্য। চারপাশে পাহাড় আর অরণ্য ঘেরা, মাঝখানে নীলাভ জলাশয়, আর দূর থেকে ভেসে আসা নানা প্রজাতির পাখির কলতান, সব মিলে এখানে সৃষ্টি হয়েছে অপার্থিব এক আবহ।
প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন প্রান্তিক লেকের শান্ত সুনিবিড় পরিবেশ। স্থানীয়দের গল্প শুনলে জানা যায়, লেকটি প্রজন্ম ধরে মাছ শিকারের উৎস। রাতের অন্ধকারে টাবুতে ক্যাম্পিং করলে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রকৃতির নীরব গান শোনা যায়।
প্রান্তিক লেক অবস্থিত বান্দরবান সদর উপজেলার সূয়ালক ইউনিয়নের হলুদিয়া-ভাগ্যকুল সড়কে। যদিও অনেকেই এটিকে রোয়াংছড়ি উপজেলার সাথে যুক্ত করেন, মূলত এটি সদর উপজেলা এলাকা থেকেই বেশি পরিচিত।

যাতায়াত: বান্দরবান শহর থেকে প্রান্তিক লেকের দূরত্ব খুব বেশি নয়। শহর থেকে সিএনজি বা চাঁদের গাড়িতে সহজেই যাওয়া যায়। শহর থেকে যাতায়াতের খরচ সাধারণত ২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে পড়ে। রাস্তার দু’পাশজুড়ে সবুজ পাহাড়ি দৃশ্য ভ্রমণপথকে করে তোলে আরও আনন্দদায়ক।
থাকার ব্যবস্থা: প্রান্তিক লেক মূলত দিনের ভ্রমণের জন্য জনপ্রিয় হলেও ক্যাম্পিং করতে চাইলে এখানে রাতযাপনের সুযোগ রয়েছে। লেকের পাড়ে টেন্ট ফেলে রাত কাটানো প্রকৃতিপ্রেমী ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের কাছে অনন্য অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। তবে হোটেল বা রিসোর্টে থাকতে চাইলে বান্দরবান শহরেই রয়েছে নানা মানের থাকার ব্যবস্থা।
আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রামে
শৈলপ্রপাত ঝর্ণা: পাহাড়ের জলে ছুঁয়ে যাওয়া শান্তি
বান্দরবান জেলার থানচি সড়কের ৮ কিলোমিটারে অবস্থিত শৈলপ্রপাত ঝর্ণা, প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এক অদ্ভুত আকর্ষণ। পাহাড়ের বুক চিড়ে বেয়ে আসা স্বচ্ছ পানির ঝরনা, বর্ষার দিনে ভ্রমণকারীদের টানে। এখানে গা ভেজানো মানেই প্রকৃতির সাথে সরাসরি সংযোগ, শান্তির খোঁজ পাওয়া যায় এই জলপ্রপাতের প্রবাহে।
শৈলপ্রপাত মূলত বর্ষাকালেই প্রাণবন্ত হয়। শীতকাল বা শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় প্রপাতটি প্রায় শুকিয়ে যায়। বর্ষার তিন মাসের এই সময়ই ঝর্ণার সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এখানে স্থানীয়দের জন্যও এটি বিশুদ্ধ পানির একটি বড় উৎস। ঝর্ণার চারপাশে পাহাড়ি সবুজ বন এবং ছোট ছোট পাথরের খেলাঘর পর্যটন অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করে। বর্ষার দিনে পাহাড়ি বায়ু, ঝর্ণার মৃদু শব্দ এবং চারপাশের সবুজ বন একসাথে মিলিয়ে পর্যটকের মনে অম্লান ছাপ ফেলে।
ঝর্ণার পাশেই গড়ে উঠেছে একটি ছোট বাজার, যেখানে স্থানীয়রা বিক্রি করেন বুননকৃত চাদর, সেলাই করা তাঁত পণ্য, হাতের তৈরি জিনিসপত্র এবং তাজা ফল- যেমন আম, আনারস, পেঁপে, কলা ইত্যাদি। পর্যটকরা এখানে থেমে ফল খেতে পারেন বা স্থানীয় শিল্প ও পণ্য ক্রয় করতে পারেন। এটি শুধু শপিং নয়, বরং স্থানীয় সংস্কৃতি ও জীবনের সান্নিধ্য উপভোগের এক সুযোগ।

যাতায়াত: শৈলপ্রপাত যেতে শহর থেকে সময় লাগে মাত্র ২০ থেকে ৩০ মিনিট। যাতায়াতের জন্য সিএনজি মাহিন্দ্র গাড়ি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং চাঁদের গাড়ি প্রায় ১ হাজার টাকা ভাড়া নেয়। তবে বেশির ভাগ পর্যটক নীলগিরি যাওয়ার পথে গাড়ি মাঝপথে থেমে এই ঝর্ণা দেখে নেন, তাই আলাদা ভাড়া লাগে না।
থাকার ব্যবস্থা: শৈলপ্রপাত ঝর্ণা মূলত দিনের সফরের জন্য পরিচিত, তবে চাইলে পর্যটকরা ঝর্ণার নিকটবর্তী এলাকায় বা থানচি ও নীলগিরি থেকে ভাড়া করা ছোট গেস্টহাউস বা হোটেলে রাত যাপন করতে পারেন। কিছু স্থানীয় কটেজ বা অতিথিশালাও রয়েছে, যা মৌসুমভিত্তিক এবং আগেভাগে বুকিং করলে সুবিধা পাওয়া যায়। রাতের জন্য সেখানে থাকার সুযোগ পাওয়া মানে শুধু বিশ্রাম নয়, বরং পাহাড়ের শীতল বাতাস, ঝর্ণার জলধারার স্বচ্ছ শব্দ এবং প্রকৃতির সঙ্গে একান্ত মিলনের এক মনোরম অভিজ্ঞতা।
আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন খাগড়াছড়ির 'নিউজিল্যান্ডে'
নীলগিরি: মেঘের আঁচলে ঢাকা পাহাড়ি স্বর্গ
বান্দরবানের সেই পাহাড়ি রত্ন, যেখানে আকাশের মেঘ পাহাড়ের গায়ে এসে যেন স্থির হয়ে বসে। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের রঙিন কাব্য এখানে প্রকৃতির ক্যানভাসে ফুটে ওঠে, আর পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে তাকালে মনে হয়, সময়ও এখানে একটু থেমে গেছে। জেলা শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই স্থানটিকে ঘিরে প্রতিটি বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা যেন এক গল্প বলে- একপাশে উঁচু সবুজ পাহাড়, অন্যপাশে গিরিখাদের গভীরতা। পথিমধ্যে মেঘের ছোঁয়ায় ভিজে যায় চারপাশ, আবার রোদে শুকিয়ে যায় মাটির সুবাস। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ২০০ ফুট উঁচুতে নীলগিরির পথচারী যাত্রাপথে চোখে পড়ে অসংখ্য পাহাড়ি গ্রাম ও মাচাং ঘর, যা পাহাড়ের সৌন্দর্যকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।

যাতায়াত: নীলগিরি পৌঁছানোর যাত্রাপথ নিজেই এক রোমাঞ্চ। জেলা শহর থেকে নীলগিরি পৌঁছানো যায় চাঁদের গাড়ি, সিএনজি মাহিন্দ্র, থ্রি হুইলার, মোটরসাইকেল বা যে কোনো ব্যক্তিগত গাড়িতে। রাস্তায় প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগলেও পথের প্রতিটি বাঁক যেন ভ্রমণকে আরও জাদুকরী করে। চাঁদের গাড়িতে একসাথে ১২ জন যাত্রী যাওয়া সম্ভব, ভাড়া সাড়ে ৪ হাজার টাকা। সিএনজি মাহিন্দ্রের ভাড়া ২ হাজার টাকা। পার্কিং ফি চাঁদের গাড়ির জন্য ৩০০ টাকা, সিএনজি মাহিন্দ্রের জন্য ১০০ টাকা এবং মোটরসাইকেলের জন্য ৫০ টাকা। সেনাবাহিনী পরিচালিত হওয়ায় নিরাপত্তার কোনো চিন্তা নেই, তবে প্রবেশের জন্য ১০০ টাকা ফি প্রদান করতে হয়।
থাকার ব্যবস্থা: নীলগিরিতে রাত্রি যাপনের জন্য রয়েছে লাক্সারি কটেজ। আগেভাগে বুকিং করলে পর্যটকরা এখানে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল পরিবেশে রাত কাটাতে পারেন। সেনাবাহিনী পরিচালিত এই পর্যটন কেন্দ্রটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আবাসন, ছোট ক্যাফে এবং বিশ্রামের জন্য মনোরম স্থানসহ পর্যটকদের সব সুবিধা নিশ্চিত করে। পাহাড় প্রেমীরা সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এবং মেঘের খেলায় মোহিত হয়ে নীলগিরির সৌন্দর্যকে মনভরা অনুভব করেন।
আরও পড়ুন: টাঙ্গাইলের যে ৫ জমিদার বাড়ি আপনাকে মুগ্ধ করবে
দেবতাখুম: পাহাড়ের কোলে এক রহস্যময় নদী
বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ির প্রাকৃতিক কোলে অবস্থিত দেবতাখুম যেন প্রকৃতির এক মনোমুগ্ধকর রহস্য। দুই পাহাড়ের মাঝে বাঁধা এই নদী ও পাথরের খাঁজ ভ্রমণকারীর চোখে এক অদ্ভুত দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে। স্বচ্ছ জলে ভেসে বেড়ানো, পাথরের প্রাকৃতিক গঠন ধরে নীরব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা, এখানেই দেবতাখুম ভ্রমণের মূল রোমাঞ্চ। দুর্গম এলাকা হলেও এই পর্যটন স্পটটি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ করে যারা প্রকৃতি ও অ্যাডভেঞ্চারের মিশ্রণ পছন্দ করেন, তাদের জন্য এটি একটি অনন্য অভিজ্ঞতা।

যাতায়াত: দেবতাখুম জেলা শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শহরের বাস স্টেশন থেকে চাঁদের গাড়ি, সিএনজি, মোটরসাইকেল বা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে সহজেই এখানে পৌঁছানো সম্ভব। সদর থেকে প্রথমে কচ্ছপতলী পর্যন্ত গাড়ি ভ্রমণ করতে হয়। এরপর গাইড নিয়ে পায়ে হেঁটে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে দেবতাখুম পৌঁছাতে। বর্ষাকালে নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকলে বোটে মাত্র ৩০ মিনিটে এই প্রাকৃতিক স্থানে পৌঁছানো যায়। তবে শীতকাল দেবতাখুম ভ্রমণের জন্য শ্রেষ্ঠ সময়, কারণ তখন নদীর পানি স্বচ্ছ ও পরিষ্কার থাকে।
থাকার ব্যবস্থা: দেবতাখুম ভ্রমণের জন্য নির্দিষ্ট গেস্ট হাউস বা কটেজের ব্যবস্থা নেই। সাধারণত একজন পর্যটক স্থানীয় রোয়াংছড়ি বা কচ্ছপতলীতে রাত্রি যাপন করে পরের দিন সকালেই দেবতাখুম ভ্রমণ করেন। শীতল পাহাড়, নদীর স্রোতধারা এবং প্রকৃতির নিস্তব্ধতা রাত্রী যাপনকে এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় পরিণত করে। পর্যটকরা এই প্রাকৃতিক পরিবেশে শহরের কোলাহল থেকে দূরে, প্রকৃতির মাঝেই স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি উপভোগ করতে পারেন।
নিরাপত্তা ও নিয়মকানুন: দেবতাখুমে ভ্রমণের সময় পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সকলকে রেজিস্ট্রেশন করতে হয় এবং ব্যক্তিগত ছবি ও আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে হয়। প্রশাসনের নিয়মকানুন মেনে চললে ভ্রমণ আরও নিরাপদ ও আনন্দদায়ক হয়। দিনের বেলা দেবতাখুমের সৌন্দর্য সর্বাধিক উন্মোচিত হয়; পাহাড়ের কোলে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলের ধ্বনি, পাথরের গঠন ও সবুজের ছায়া মিলিয়ে এক মনোরম অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন রাজবাড়ীর ঐতিহ্যবাহী ৪ দর্শনীয় স্থানে
নাফাখুম: বাংলার নায়াগ্রা
বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নে অবস্থিত নাফাখুম ঝর্ণা যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি। উঁচু পাহাড়ের বুক ভেদ করে নেমে আসা এই ঝর্ণার প্রবাহ যে কোনো পর্যটকের মনোলোভা এবং রোমাঞ্চিত করে তোলে। নদী ও পাহাড়ের সঙ্গে মিলিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক অনন্য দৃশ্যরূপে ফুটে ওঠে। নাফাখুম ভ্রমণ প্রেমীদের কাছে এক মাইলফলক, যেখানে প্রকৃতি ও অ্যাডভেঞ্চার একসাথে অনুভূত হয়।
নাফাখুমে যাত্রা শুধু সৌন্দর্য দেখার জন্য নয়, বরং একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রথমে জেলা শহর থেকে থানচি পৌঁছাতে হয়। জেলা সদর থেকে থানচি পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৯২ কিলোমিটার। যাত্রা করতে চাঁদের গাড়ি, গণপরিবহন বা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করা যায়। চাঁদের গাড়িতে ভাড়া পড়বে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা, আর গণপরিবহনে জনপ্রতি ২৮০ টাকা। থানচি পৌঁছে নিরাপত্তার স্বার্থে প্রশাসনের কাছে রেজিস্ট্রেশন করানো বাধ্যতামূলক, যেখানে পর্যটকের আইডি কার্ড প্রয়োজন।

যাতায়াত: থানচি বাজার থেকে রেমাক্রী পর্যন্ত নদীপথে বোটে যেতে হয়, যা সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। প্রতিটি ইঞ্জিন চালিত বোটে চার জন করে যাত্রী যেতে পারে এবং প্রতিটি বোটের ভাড়া ৪,৫০০ টাকা। রেমাক্রী পৌঁছে পাহাড় বেয়ে পায়ে হেঁটে ঝিরি পার হয়ে প্রায় এক ঘণ্টা পরই নাফাখুম ঝর্ণার কাছে পৌঁছানো যায়। বর্ষার সময় নদীর স্রোত তীব্র হওয়ায় ঝর্ণায় যাত্রা কিছুটা বিপজ্জনক, তাই বর্ষার পরে শীতকাল ও শুকনো মৌসুম নাফাখুম ভ্রমণের জন্য শ্রেষ্ঠ সময়।
থাকার ব্যবস্থা: নাফাখুম ভ্রমণ একদিনে শেষ করা সম্ভব নয়। তাই থানচি বাজারে বা রেমাক্রীতে রাত্রি যাপন করা বাধ্যতামূলক। রেমাক্রীতে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ রাত্রিযাপন ও খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রকৃতির কোলাহলমুক্ত পরিবেশে নদীর স্রোতধারার শব্দ আর ঝিঁঝি পোকার কণ্ঠরলে রাত কাটানো এক মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা। ভোরের আলোয় নদী, পাহাড় এবং সবুজের সমারোহ পর্যটকের মনে এক অনন্য স্মৃতি রেখে যায়।
আরও পড়ুন: টাঙ্গাইলের ৫ দর্শনীয় স্থান আপনাকে মুগ্ধ করবে, ঘুরে আসুন এক দিনেই
বগালেক: আকাশ, পাহাড় ও হ্রদের মায়াজাল
বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় কেওক্রাডং পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব সৃষ্টি 'বগালেক', স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় বগাকাইন লেক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই হ্রদটি ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে হয়ত মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বা উল্কাপিণ্ড পতনের ফলে গঠিত। অনেকে এটিকে ড্রাগন লেক নামেও ডাকে। পাহাড়ের কোলে সাজানো ১৫ একর বিস্তীর্ণ এই লেক, আকাশ, পাহাড় আর নীল জলের এক অপূর্ব মেলবন্ধনে পর্যটকদের মন মাতিয়ে রাখে। সকাল, সন্ধ্যা কিংবা রাতে, প্রতি মুহূর্তে এখানে ভিন্ন ভিন্ন রূপের খেলা দেখতে পাওয়া যায়। যাত্রাপথের সমস্ত ক্লান্তি এক মুহূর্তে দূর করে লেকের শান্ত ও শীতল জল।
বগালেক শুধু একটি হ্রদ নয়, এটি এক অভিজ্ঞতা যেখানে পথের প্রতিটি মুহূর্ত, পাহাড়ি রাস্তাগুলোর বাঁক, নীল জল ও পাহাড়ের সমাহার পর্যটকের মনে অম্লান ছাপ ফেলে। পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা এই নীলরূপ যেন প্রকৃতির এক চিরন্তন গল্প বলে, যা প্রত্যেক ভ্রমণপিপাসুর মনে স্মৃতির মতো বাঁচে।

যাতায়াত: বান্দরবান শহর থেকে বগালেক পৌঁছানো এখন অনেক সহজ হয়েছে। এক সময় রুমা হয়ে যেতে হতো, কিন্তু বর্তমানে সরাসরি গাড়িতে পৌঁছানো সম্ভব। তবে পাহাড়ি রাস্তা হওয়ায় চাঁদের গাড়ি বা সেনাবাহিনীর ভি-৭ ছাড়া অন্য কোনো গাড়িতে যাত্রা করা সম্ভব নয়। পাহাড়ি বাঁকা উঁচু নিচু পথ ভ্রমণকে স্বপ্নের মতো করে তোলে; প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি পাহাড়ি গিরিখাদ যেন পর্যটকের মনে রোমাঞ্চের অনুভূতি যোগ করে। বান্দরবান থেকে বগালেক পৌঁছানোর জন্য গাড়ির ভাড়া প্রায় ১০ হাজার টাকা। বর্ষার সময় যাত্রা কিছুটা কঠিন হওয়ায় শীতকাল বগালেক ভ্রমণের জন্য সেরা সময়। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী পর্যটকরা যদিও সব বাধা অতিক্রম করে বগালেকের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে ছুটে আসে।
থাকার ব্যবস্থা: বগালেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে রাত কাটানো প্রায় অপরিহার্য। পাহাড়িদের তৈরি বেশ কিছু কটেজে পর্যটকরা রাত্রিযাপন করতে পারেন। সূর্যাস্তের আগুন লাল আভায়, নীল জলরূপের সঙ্গে পাহাড়ের ছায়া মিলিয়ে গড়ে তোলে এক অপরূপ চিত্র। কটেজ থেকে এই দৃশ্য উপভোগ করা, পাহাড় আর লেকের মাঝে রাত কাটানো, প্রকৃতির নিঃশব্দ সঙ্গীত শুনে ঘুমানো- সব মিলিয়ে বগালেকের অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে এক অতুলনীয়।
আরও পড়ুন: এক দিনে ঘুরে আসুন গাজীপুরের মনোরম ৬ দর্শনীয় স্থান
তমাতুঙ্গী: পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যাস্তের মুগ্ধতা
বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মণ্ডিত এক অপূর্ব দর্শনীয় স্থান হলো তমাতুঙ্গী। থানচি সদর থেকে মিয়ানমার সীমান্ত সড়কের মাত্র চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পর্যটন স্পটটি পাহাড়ের চূড়ায় গড়ে ওঠার কারণে সূর্যাস্তের অপরূপ রূপ উপভোগ করার জন্য পর্যটকরা বছরের প্রতিটি সময়ে ছুটে আসে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত তমাতুঙ্গী যেন এক অবিস্মরণীয় প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট, যেখানে চোখে পড়ে সারি সারি সবুজ পাহাড়ের চূড়া আর দূর থেকে হেলান দিয়ে থাকা সাদা মেঘের খেলা।
তমাতুঙ্গীর বিশেষ আকর্ষণ হলো এখান থেকে চারটি প্রধান দর্শনীয় স্থান দেখা যায়। এই চূড়ার এক চোখে দেখা যায় দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ তজিংডং বিজয়, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চূড়া কেওক্রাডং, এবং দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়কপথ ডিম পাহাড়ের চূড়া। পাহাড়ের চূড়ার দৃশ্য যেন প্রকৃতির এক অমোঘ উপহার, যা পর্যটকের মনকে নিঃশব্দে বিমোহিত করে। স্থানীয় দর্শনার্থীদের পদচারণায় তমাতুঙ্গী সারাবছরই মুখরিত থাকে।

সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত তমাতুঙ্গী পর্যটন স্পটে দুটি ভিউ পয়েন্ট রয়েছে। এক প্রান্তে সিঁড়ি বেয়ে উঠা সৌন্দর্য অবলোকন টাওয়ার, একটি পানির ফোয়ারা এবং গোল কাঠের তৈরি বসার সিট পর্যটকদের বিশ্রামের সুযোগ দেয়। অপর প্রান্তে খোলা জানালা ও ফটকের আদলে শিল্পকর্ম, বিশাল চত্বর এবং চারপাশে বসার পাকা সিটে পর্যটকরা আরাম করতে পারেন। মাঝখানে রয়েছে এক ভাস্কর্যের মতো শিল্পকর্ম, যা পুরো পরিবেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। সবচেয়ে বেশি মনোহারিণী দৃশ্য হলো পড়ন্ত বিকেলে বা গোধূলি বেলায় সূর্যাস্ত। হলুদ ও কমলার আভায় পাহাড়ের চূড়া রোমাঞ্চকর এক রূপ ধারণ করে, যা ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। সন্ধ্যার পর চাঁদের আলোয় পাহাড়টি হয়ে ওঠে আরও রহস্যময়, যদিও নিরাপত্তার কারণে রাতের বেলা দীর্ঘ সময় অবস্থান করা অনুমোদিত নয়।
যাতায়াত: তমাতুঙ্গী পৌঁছাতে বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৯২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। থানচি থেকে চার কিলোমিটার আরও দূরে স্পটটির অবস্থান। যাতায়াতের জন্য মোটরসাইকেল, প্রাইভেট গাড়ি বা ভাড়া চালিত যে কোনো চার চাকার গাড়ি ব্যবহার করা যায়। পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য ভ্রমণকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে, যেখানে পাহাড়ের কোলে কোলে মেঘের খেলা ও সবুজের সমারোহ পর্যটকের মনে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে।
থাকার ব্যবস্থা: তমাতুঙ্গীতে সরাসরি লজ বা হোটেলের ব্যবস্থা সীমিত। তবে থানচি বাজার বা বান্দরবান জেলা সদরে থাকতে পারলে সহজেই দিনের ভ্রমণ করে তমাতুঙ্গী উপভোগ করা যায়। পর্যটকরা চাইলে থানচি থেকে ৪ কিলোমিটার দূরবর্তী পাহাড়ী পথ ধরে দিনের আলোতেই দর্শন শেষে ফিরে আসেন। এছাড়াও, ভ্রমণকারীরা যদি প্রাকৃতিক পরিবেশে রাত্রি যাপন করতে চান, তবে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্থানীয় অনুমতি নিয়ে পাহাড়ের আশেপাশে টেন্ট বা সাময়িক শিবিরে থাকা সম্ভব। এতে সূর্যাস্ত ও চাঁদের আলোয় পাহাড়ের রহস্যময় সৌন্দর্যকে আরও কাছ থেকে অনুভব করা যায়।
আরও পড়ুন: একদিনে ঘুরে আসুন নারায়ণগঞ্জের মনোরম ৬ দর্শনীয় স্থান
কেওক্রাডং: পাহাড়ের রাজা ও মেঘের খেলা
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ১৭২ ফুট উঁচু কেওক্রাডং বাংলাদেশের পাহাড় প্রেমীদের কাছে 'পাহাড়ের রাজা' হিসেবে পরিচিত। রুমা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পর্বতশৃঙ্গ ছোট-বড় পাহাড়-পর্বতের সমন্বয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। সবুজের সমারোহ, শীতল ঝর্ণা, আঁকাবাঁকা পথ, পাহাড়ি রাস্তা এবং চূড়ায় মেঘের লুকোচুরি—এই সব মিলিয়ে কেওক্রাডং-এর সৌন্দর্য পর্যটকদের মনে এক অদ্ভুত নেশা জাগায়। রুমা থেকে যাত্রাপথে মাঝেমধ্যে পড়বে দার্জিলিং পাড়া নামে একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গ্রাম। অনেক পর্যটক এই অপূর্ব গ্রামে যাত্রা বিরতি নিয়ে স্থানীয় জীবন ও সংস্কৃতির ছোঁয়া পান।
কেওক্রাডংয়ের চারপাশে পাহাড়ের কোলে কোলে খোঁজ মিলবে ছোট ছোট ঝর্ণা, পাহাড়ি গিরিখাদ, এবং দূর থেকে মেঘের নাচ। রোমাঞ্চপ্রেমী ও প্রকৃতি ভালোবাসীদের কাছে এই স্থান হয়ে ওঠে এক অনন্য গন্তব্য। বান্দরবান জেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান যেমন থানচির ডিম পাহাড়, আলিকদমের মারাইতং পাহাড়, রুমার রিঝুক ঝরনা, রোয়াংছড়ির শীলবান্ধা ঝরনা, সদরের রুপালী ঝরনা- এই সবকিছুর সঙ্গে কেওক্রাডং এক সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা উপহার দেয়।

যাতায়াত: কেওক্রাডংয়ের পথে যাত্রা সম্পূর্ণরূপে পাহাড়ি ও দুর্গম। রুমা থেকে শুরু করে পাহাড়ি উঁচু নিচু পথ অতিক্রম করতে হয়। যাতায়াতের জন্য চাঁদের গাড়ি, সেনাবাহিনীর ভাড়া গাড়ি বা ব্যক্তিগত ৪ চাকার গাড়ি ব্যবহার করা যায়। পাহাড়ি পথের কারণে ছোট গাড়ি বা সাধারণ বাস দিয়ে সরাসরি যাত্রা সম্ভব নয়। রুমা থেকে কেওক্রাডং পৌঁছাতে সাধারণত ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। যাত্রার নিরাপত্তার জন্য পর্যটকদের অবশ্যই প্রশাসনের রেজিস্ট্রেশন ও স্থানীয় গাইড সঙ্গে রাখতে হয়।
থাকার ব্যবস্থা: কেওক্রাডং-এর প্রাকৃতিক পরিবেশে বিশেষ ধরনের স্থায়ী আবাসন না থাকলেও পাহাড়ের ঢালে এবং রুমা উপজেলায় কিছু পাহাড়ি কটেজ ও গেস্ট হাউজ আছে, যেখানে আগেভাগে বুকিং দিলে পর্যটকরা রাত্রিযাপন করতে পারেন। পাহাড়ি পরিবেশ এবং ঝর্ণার কাছাকাছি অবস্থান এখানে রাত্রি যাপনের অভিজ্ঞতাকে করে তোলে আরও অনন্য। বর্ষাকালে ঝর্ণা ও নদীর পানি বেড়ে যাওয়া কারণে রাত্রি যাপন সীমিত নিরাপত্তার কারণে সুপারিশ করা হয় শীতকাল বা বন্যার পরে।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রাম শহরের যেসব জায়গা আপনাকে মুগ্ধ করবে
বান্দরবান কখন ঘুরতে যাবেন?
বান্দরবান ভ্রমণের সেরা সময় মূলত আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে, কারণ এটি পাহাড়ি অঞ্চল এবং ঋতু অনুযায়ী সৌন্দর্য ও ভ্রমণের সুবিধা ভিন্ন হয়।
শীতকাল: নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে, এখানে ভ্রমণ সবচেয়ে আরামদায়ক। এই সময় ঠান্ডা হাওয়া বইতে থাকে, আকাশ থাকে পরিষ্কার, আর পাহাড়ের চূড়া থেকে দূরদূরান্ত পর্যন্ত দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখা যায়। নীলাচল, মেঘলা, কেওক্রাডংসহ সব জায়গায় এই সময়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, এবং রাস্তা ও যাতায়াতের জন্যও নিরাপদ থাকে।
গ্রীষ্মকালে: মার্চ থেকে মে আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে গরম এবং আর্দ্র থাকে। তবে এই সময় পর্যটক কম থাকায় হোটেল বা কটেজে জায়গা পাওয়া সহজ হয়। দীর্ঘ হাইকিং বা পাহাড়ি ভ্রমণে গরমের কারণে কিছুটা অসুবিধা থাকতে পারে।
বর্ষাকাল: জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বান্দরবানের প্রকৃতি হয় সবচেয়ে সবুজ ও প্রাণবন্ত। ঝর্ণাগুলো পূর্ণ প্রবাহে থাকে, পাহাড়ের গায়ে মেঘের খেলা দেখার অভিজ্ঞতা অসাধারণ হয়। তবে এই সময়ে রাস্তা কাদা ও ভেজা থাকায় দূরত্বের যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। শৈলপ্রপাত ঝর্ণা, নীলাচল ও মেঘলার মতো জায়গাগুলো বর্ষাকালে সবচেয়ে সুন্দর হয়।
সারমর্মে বলা যায়, শীতকাল সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক, বর্ষাকাল প্রকৃতির রঙের খেলা দেখার জন্য চমৎকার, আর গ্রীষ্মকাল ভিড় কম থাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করার জন্য সুবিধাজনক। এই তথ্যের ভিত্তিতে পর্যটকরা তাদের যাত্রার সময় বেছে নিতে পারেন, যাতে বান্দরবানের প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মনোরম পরিবেশ পুরোপুরি উপভোগ করা যায়।