যে অস্ত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘায়েল করবে চীন
ইউটিউবে ড্রোন নির্মাতা স্কাইডিও কোম্পানির একটি প্রমোশনাল ভিডিওতে দেখা যায়, উড়তে গিয়ে রাস্তার পাশের পোলে আঘাত খেয়ে ছিটকে মাটিতে পড়ছে ছোট্ট একটি ড্রোন। এর পর লেখা ভেসে ওঠে ‘ড্রোনস আর ডাম্ব, স্কাইডিও ইজ স্মার্ট।’ এ ভিডিওতে সাধারণ ড্রোনকে নির্বোধ হিসেবে তুলে ধরা হলেও দাবি করা হয় স্কাইডিও কোম্পানির ড্রোন বুদ্ধিমান। এটির রয়েছে ব্যবহারকারীর চাহিদা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওড়ার সক্ষমতা।
স্কাইডিও মূলত একটি মার্কিন কোম্পানি। বিশ্বের ড্রোনের আকাশে যেখানে চীনে নির্মিত সস্তা কিন্তু কার্যকর ড্রোনের জয়জয়কার, সেখানে মার্কিনিদের সামনে চীনা ড্রোনের বিকল্প হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছিল স্কাইডিও। নিরাপত্তাজনিত কারণে চীনের তৈরি যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভরতা কমানোর অংশ হিসেবে মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে স্কাইডিওর ড্রোন।
এতদিন সবকিছু ভালোই চলছিল স্কাইডিওর, তবে বিপত্তি দেখা দেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগ দিয়ে। স্কাইডিওর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চীন। আর এতেই স্কাইডিওর এই ‘বুদ্ধিমান’ ড্রোনগুলো আর কতদিন উড়তে পারবে তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। কারণ স্কাইডিওর ড্রোনগুলোতে ব্যবহৃত ব্যাটারিগুলোর উৎস মূলত চীন।
পাখা ছাড়া পাখি যেমন, ব্যাটারি ছাড়া ড্রোনও তেমন। চীন ড্রোন না পাওয়ায় রাতারাতি চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ড্রোন নির্মাতা কোম্পানিটি। কারণ সহসাই চীনা ব্যাটারির বিকল্প ‘সাপ্লাই চেইন’ খুঁজে বের করা কিংবা নতুন ‘সাপ্লাই চেইন’ পদ্ধতি তৈরি করা কোন সহজসাধ্য কাজ নয়। এ জন্য লাগতে পারে কয়েক বছর পর্যন্ত সময়।
ময়দানের যুদ্ধ নয়, এবার রণক্ষেত্র ‘সাপ্লাই চেইন’
‘সাপ্লাই চেইন’-এর যে সংকটের মুখোমুখি হলো মার্কিন ড্রোন নির্মাতা কোম্পানি স্কাইডিও, সাদা চোখে এটিকে সাধারণ একটি অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব হিসেবে মনে হলেও এর তাৎপর্য আরও গভীরে নিহিত। পৃথিবী বদলাচ্ছে; বদলাচ্ছে যুদ্ধের ধরন, যুদ্ধের ক্ষেত্র।
আরও পড়ুন: ‘বাণিজ্য যুদ্ধে’ কেউ জিতবে না, ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির জবাবে চীন
বিশ্লেষকদের মতে, সমরবলে অসম্ভব শক্তিশালী পরমাণু ক্ষমতাসম্পন্ন চীনকে কাবু করতে সামরিক ক্ষেত্রের বদলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে বেছে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। আর বৃহত্তর এই যুদ্ধের অংশ হিসেবে চীনের বিরুদ্ধে ট্যারিফের কামান দাগানোর ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ নতুন নয়। নিজের প্রথম দফার প্রেসিডেন্সিতে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হওয়া চীনা পণ্যের ওপর একের পর এক ট্যারিফ আরোপ করতে থাকেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে পরাজিত করলেও তার চীনবিরোধী এ অর্থনৈতিক নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন ডেমোক্রাট দলীয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ২০২৪-এর নির্বাচনী প্রচারে নেমেই চীনের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে শুরু করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর হোয়াইট হাউজের প্রশাসন সাজানো থেকে শুরু করে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, চীনের বিরুদ্ধে একই ধরনের আক্রমণাত্মক মানসিকতায় রয়েছেন তিনি। এমনকি ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউজের দায়িত্বগ্রহণের দিনই চীনের বিরুদ্ধে নতুন ট্যারিফ আরোপের হুমকিও দিয়ে রেখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্পের প্রথম দফার প্রেসিডেন্সির সময় অনেকটা মুখ বুঁজেই মার্কিন ট্যারিফ আক্রমণ সহ্য করে নিয়েছিল চীন। এমনকি বাইডেনের সময়ও চীনবিরোধী বিভিন্ন বাণিজ্যিক পদক্ষেপের ক্ষেত্রেও ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে কড়া বিবৃতির বাইরে বেইজিংকে দৃশ্যমান খুব বেশি পাল্টা ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। তবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এর ব্যতিক্রম হতে যাচ্ছে। এবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি আঘাতের ‘সমান ও বিপরীতমুখী’ জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত চীন। মূলত দাঁতে দাঁত চেপে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অর্থনৈতিক আঘাত তারা সহ্য করেছে পাল্টা জবাব দেয়ার সক্ষমতা অর্জনের জন্য।
আরও পড়ুন: ট্রাম্পের ট্যারিফ যে প্রভাব ফেলবে কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর
তবে বিশ্লেষকদের মতে, চীনের সে প্রস্তুতির পালা শেষ হয়েছে। বেইজিং মনে করছে এখন সময় হয়েছে ওয়াশিংটনকে কড়া জবাব দেয়ার। আর মার্কিন ড্রোন নির্মাতা স্কাইডিওর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসনকে সেই বার্তাই দিয়ে রাখলো চীনা কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে বেইজিংয়ের বার্তা পরিষ্কার, ট্যারিফের মাধ্যমে চীনকে আঘাত করা হলে তার পরিণাম ভুগতে হবে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে।
‘সাপ্লাই চেইন’ বন্ধ করে মার্কিন ট্যারিফের জবাব দেবে চীন
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ট্যারিফ গোলা’র জবাব মার্কিন কোম্পানিগুলোর ‘সাপ্লাই চেইন’ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করার মাধ্যমে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে চীন -- এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনভিত্তিক মার্কিন থিংকট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ জুড ব্লাংকেট নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, প্রথম দফার বাণিজ্য যুদ্ধের সময় বেইজিং মার্কিন ট্যারিফের আঘাত মেনে নিয়ে বরং সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা চালায়। তবে এই আঘাত আর মুখ বুজে সহ্য করা হবে না, এখন তারা এই বার্তা দিতে চায়। এটা পরিষ্কার যে নিজেদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন ট্যারিফের ঢেউ আছড়ে পড়ার বিষয়টি আর চেয়ে চেয়ে দেখবে না চীন।
মূলত মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের প্রস্তুত করেছে বেইজিং। ২০১৮ সালে নিজের প্রথম আমলে যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে থাকেন, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা আঁটতে থাকে বেইজিং। মার্কিন কোম্পানিগুলোকে শায়েস্তা করতে চুক্তি পর্যালোচনাসহ প্রয়োজনীয় আইন পাস এবং অন্যান্য ‘পেপারওয়ার্ক’ এর কাজ তারা তখন থেকেই শুরু করে। এসব কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের উপায় তৈরি করে রাখে বেইজিং। মার্কিন কোম্পানিগুলো যেন তাদের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করাই ছিল চীনের এসব পদক্ষেপের উদ্দেশ্য।
বর্তমান পৃথিবীর শিল্প উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় যে কোনো সময়ই ভজঘট পাকানোর ক্ষমতা রাখে ‘বিশ্বের কারখানা’ হিসেবে পরিচিত চীন। আর যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবারের বাণিজ্য যুদ্ধে নিজের সেই সক্ষমতার প্রতিফলন ঘটাতে চায় তারা। এ জন্যই মার্কিন ট্যারিফের বিপরীতে অস্ত্র হিসেবে ‘সাপ্লাই চেইন’কে ব্যবহার করতে শুরু করেছে চীন। যার অংশ হিসেবেই মার্কিন ড্রোন কোম্পানি স্কাইডিওর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বেইজিং।
চীনের এই নিষেধাজ্ঞা স্কাইডিওর জন্য কতটা বেদনাদায়ক তা ফুটে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী অ্যাডাম ব্রাইয়ের বক্তব্যেই। তার ড্রোনের ক্রেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এটা স্কাইডিওর ওপর আক্রমণ, একই সঙ্গে এটি আপনাদের ওপরও আক্রমণ।
লড়াই চায় না চীন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের আঘাতের জবাব দেয়া হবে
অবশ্য বেইজিং এখনও ওয়াশিংটনের সঙ্গে পূর্ণমাত্রার বাণিজ্য যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চায় বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ অন্যান্য মার্কিন কর্মকর্তারা যেভাবে চীনের বিরুদ্ধে খোলাখুলি লড়াইয়ের হাঁকডাক দিচ্ছেন, বিপরীতে চীন অনেকটাই সংযত ও সতর্ক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। পাশাপাশি গণহারে নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে তারা বেছে বেছে সুনির্দিষ্ট মার্কিন কোম্পানিগুলোকেই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনছে। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটনকে বেইজিং এই বার্তাই দিতে চায় যে, তারা বাণিজ্য যুদ্ধ চায় না। তবে চীনের ওপর এই লড়াই চাপিয়ে দেয়া হলে, এর উপযুক্ত জবাব দেয়া হবে।
আরও পড়ুন: ট্রাম্পের সম্ভাব্য মন্ত্রীদের বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার হুমকি
এজন্য মার্কিন কোম্পানিগুলোর ‘সাপ্লাই চেইন’ ব্যবস্থা ধ্বংস করাকেই টার্গেট হিসেবে নিয়েছে বেইজিং। পাশাপাশি মার্কিন কোম্পানিগুলোকেও এই বার্তা দেয়া হচ্ছে, তারা যেন অন্ধের মতো চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ না করে। যদি তারা তা করে, তবে তাদের কঠোর মূল্য চোকাতে হবে।
এ ব্যাপারে কনসালটিং প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল রিস্কের বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু গিলহোম নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে মার্কিন সরকারকে বার্তা দিতে চায় চীন। তবে একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং কোম্পানিগুলোর কাছে এ ব্যাপারে ভুল বার্তা না যায়, তারা সে ব্যাপারেও সতর্ক।
বিষয়টি পরিষ্কার চীনের শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদকীয়তেও। স্কাইডিওর উদাহরণ টেনে গ্লোবাল টাইমস অন্যান্য মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, তারা যেন চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত না হয়। এর ব্যত্যয় হলে তাদের পরিণাম ভোগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
]]>