এখন সীমান্তে স্থল মাইন বিস্ফোরণে হতাহত ঠেকাতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিতের পাশাপাশি চলছে নিয়মিত মাইকিং, সচেতনতামূলক সভা ও সর্তকবার্তা প্রচার। মাইন বিস্ফোরণে হাত-পা হারানো ভুক্তভোগীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেই জানানো হচ্ছে এর ভয়াবহতা। পাশাপাশি আহতদের পাশে দাঁড়াচ্ছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সদর থেকে আনুমানিক ১৩ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত আশারতলি সীমান্ত। সদর থেকে একটু এগিয়ে গেলেই শুরু হয় পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক। যেখানে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকার একটি পাহাড়ের ওপর অবস্থান করছে বিজিবির আশারতলি বিওপি (বর্ডার আউটপোস্ট)।
সাম্প্রতিক এক সচেতনতামূলক কর্মসূচিকে ঘিরে আশারতলি বিওপিতে জড়ো হয়েছিলেন প্রায় ১০০ জন নানা বয়সী মানুষ। এদের মধ্যেই ছিলেন সীমান্তে স্থল মাইন বিস্ফোরণে হাত-পা হারানো অন্তত ১৬ জন। এরা সবাই এখন চিরতরে পঙ্গু।
সেখানে কথা হয় নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের দক্ষিণ মৌলভীরকাটা এলাকার যুবক ওমর ফারুকের সঙ্গে। বয়স এখনো ২৫ পেরোয়নি। গেল জুন মাসে সীমান্তে গিয়ে স্থল মাইন বিস্ফোরণে পা হারিয়ে এখন তাকে চলাফেরার জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে ক্র্যাচের উপর। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে, ক্র্যাচের ভর দিয়ে বর্ণনা দিলেন তিনি তার জীবন পাল্টে দেয়া সেই মুহূর্তের।
তিনি জানান, স্থানীয় এক ব্যক্তির শ্রমিক হিসেবে মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে গরু আনতে গিয়ে জুন মাসে চেইনছড়ি সীমান্তে মাইনের বিস্ফোরণে পা হারান তিনি। সামান্য মজুরির আশায় সীমান্তে পা রেখেই এখন সারাজীবনের জন্য পঙ্গু। ঘটনার পর যে ব্যক্তির হয়ে গরু আনতে গিয়েছিলেন তিনি আর খোঁজও নেননি। তবে বিজিবির পক্ষ থেকে কিছু নগদ অর্থসহ নানাভাবে সহায়তা করা হয়েছে।
সেদিন ছিলেন রামু উপজেলার গর্জনিয়ার বাসিন্দা মো. আব্দুল্লাহ। এক বছর আগে সীমান্তের ওপারে গরু আনতে গিয়ে স্থল মাইনে দুই পা হারান তিনিও।
তিনি বলেন, কোনো মানুষ যেন ভুলেও আর সীমান্তে না যান। এটা এখন আশপাশের সবাইকে বলি। আমি ভুল করেছি, চাই না অন্যরা একই ভুল করুক।
আরও পড়ুন: সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে রক্তাক্ত রোহিঙ্গা যুবক
‘অঁইক্কা বোমা ফোডে, অঁড়ে আর ন যায়ুম’ এই শিরোনামে স্থল মাইন বিস্ফোরণ রোধে সীমান্তে না যাওয়ার প্রচারণা চালাচ্ছে বিজিবি। আশারতলি বিওপিতে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে আহতদের উপস্থিতির পাশাপাশি স্থানীয়দের জন্য ছিল মেডিকেল ক্যাম্প ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ।
সেখানে উপস্থিত পঙ্গুদের গল্প ছিল প্রায় একই রকম। কেউ গরু, কেউ সিগারেট, কেউ মাদকসহ বিভিন্ন চোরাচালানি পণ্য আনার সময় মাইনে পা দিয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও হাত-পা হারিয়েছেন। এসব পণ্যের বিনিময়ে মজুরি দেয়া হতো ২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এস কে এম কফিল উদ্দিন কায়েস জানান, নাইক্ষ্যংছড়ির ১১ বিজিবির আওতাধীন সীমান্ত এলাকায় ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত স্থল মাইন বিস্ফোরণে ১৬ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০২৩ সালে ৩ জন, ২০২৪ সালে ৩ জন এবং ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১০ জন আহত হয়েছেন।
তিনি আরও জানান, এ প্রেক্ষাপটে গত এক মাস ধরে ‘অঁইক্কা বোমা ফোডে, অঁড়ে আর ন যায়ুম’ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এর ইতিবাচক প্রভাবও মিলেছে। গত এক মাসে সীমান্তে নতুন করে মাইন বিস্ফোরণে কেউ আহত হননি।
তিনি বলেন, সীমান্তে অবৈধভাবে পণ্য আনানেয়ার জন্যই এসব দুর্ঘটনা ঘটে। এর নেপথ্যে থাকা গডফাদারদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। ইতোমধ্যে সীমান্তে নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত শাহীন ডাকাতসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। অন্যদের ধরতেও চেষ্টা চলছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এখানকার মানুষজনের মধ্যে সচেতনতা ও শিক্ষার হার তুলনামূলক কম। কারণ আমরা পার্বত্য এলাকায় অবস্থান করছি, যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও আমরা সচেতনতা তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
আরও পড়ুন: নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে নারীর পা বিচ্ছিন্ন
আশারতলি সীমান্ত থেকে জামছড়ি দুই কিলোমিটার, আর সেখান থেকে লেম্বুছড়ি সীমান্ত ৯ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ি দুর্গম এলাকা। সীমান্ত সড়কের পাশে মাঝে মধ্যেই দেখা মেলে বন্য হাতি, বানরের চলাফেরা। এই ১১ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে কিছু দূর পরপরই রয়েছে বিজিবির বিশেষ চৌকি। ১২ ঘণ্টা করে পালা করে ২৪ ঘণ্টা সজাগ অবস্থানে থাকেন বিজিবি সদস্যরা। সেখানে রয়েছে এপিসি যানসহ বিশেষ টহল।
সীমান্তে একটু এগোতেই চোখে পড়ে লাল পতাকা ও সতর্কতামূলক বিলবোর্ড। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে এই সতর্কতা দেয়া হয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির সহকারী পরিচালক মো. আল আমিন বলেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে লাল পতাকা স্থাপন করে সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। এই ১১ কিলোমিটার এলাকায় ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। সব স্থানে লাল পতাকা দেয়া হয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে চলাচল বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দ্রুতই তা বাস্তবায়ন করা হবে।
তিনি আরও জানান, সীমান্তের কাছাকাছি যেন কেউ না যায়, সে জন্য বিজিবি এখন আগের চেয়ে আরও কঠোর। ফলে এক মাসে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে প্রতিদিন চলছে মাইকিং। বিজিবির পক্ষ থেকে স্থানীয়দের সাবধান করা হচ্ছে যেন কেউ ভুলেও সীমান্তে না যান। প্রচারণায় ব্যবহার করা হচ্ছে আঞ্চলিক ভাষার স্লোগান- 'অঁইক্কা বোমা ফোডে, অঁড়ে আর ন যায়ুম'। আর এর অর্থ- 'ওখানে বোমা ফাটে, ওখানে যাব না'।