চুরির অপবাদে ২ কিশোরকে রাতভর মারধর, সালিশে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা

২ সপ্তাহ আগে
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে দোকানে চুরির অপবাদে দুই কিশোরকে বাড়ি থেকে তুলে এনে রাতভর মারধর করে আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে।

রোববার (৯ নভেম্বর) রাতে তাদের মোবাইল ফোনে ডেকে আনা হয়। পরে রাত ২টা থেকে সোমবার (১০ নভেম্বর) ফজর পর্যন্ত উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের তারাপুর বাজারে মারধরের ঘটনা ঘটনা ঘটে। সকালে বাজার সংলগ্ন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল করিম বিশ্বাসের ‘স’ মিলে সালিশ বসিয়ে তাদের জরিমানা করা হয় ৩০ হাজার টাকা।


ভুক্তভোগীরা হলো: একই ইউনিয়নের তারপুর গ্রামের দিনমজুর রাজু হোসেনের ছেলে রাকিব হোসেন (১৭) এবং বাদশা আলমের ছেলে সাইফ হোসেন (১৭)। তারা বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছে।


অপরদিকে, এ ঘটনায় রাকিবকে মারধরের ৪৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সোমবার দুপুরে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।


ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন মিলে রাকিবের হাত, মুখ ও গলা চেপে ধরে রেখেছেন। আরেকজন বাঁশের লাঠি দিয়ে মারধর করছেন। এ সময় ‘আমি কিছু করি নাই, ও মা গো’ বলে  চিৎকার করতে দেখা যায় রাকিবকে।


আরও পড়ুন: চোর সন্দেহে যুবদল নেতাকে ধাওয়া, গণপিটুনিতে ভেঙ্গে গেল পা!


জানা গেছে, রোববার সন্ধ্যায় উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের তারাপুর বাজারের বিকাশ ও নগদ ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের দাদি বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। আজাদ দোকান বন্ধ করে দাদির বাড়িতে চলে যান। পরে রাত ১১টার দিকে ফিরে দেখেন তার দোকানের পিছনের দরজা খোলা। ড্রয়ারে টাকা, সিগারেটসহ কিছু মালামাল নেই। এ সময় বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে আজাদ রাকিব ও সাইফকে সন্দেহ করেন।


পরে তিনিসহ তার লোকজন উপজেলার নন্দলালপুর এলাকা থেকে রাত ২টার দিকে ফোনে যোগাযোগ করে রাকিব ও সাইফকে বাজারে ডেকে আনেন এবং আজাদ, তার চাচাতো ভাই মিজান, হাসানসহ বেশ কয়েকজন রাতভর কাঠের বাটাম ও বাঁশের লাঠি দিয়ে ব্যাপক মারধর করে চুরির কথা স্বীকার করিয়ে আটকে রাখেন।


এরপর সোমবার সকালে ‘স’ মিলে সালিশ বসান জগন্নাথপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল করিম বিশ্বাস। সালিশে দোকানদারের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই কিশোরকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন বিএনপি নেতা। এরপর সাইফের মা পলি খাতুন ১০ হাজার টাকা পরিশোধ এবং অবশিষ্ট টাকা বাকি রেখে তাদের উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যান। সকাল ১০টার দিকে তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।


সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলার বারান্দায় চিকিৎসাধীন রয়েছে রাকিব ও সাইফ। তাদের হাত, পা, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের ক্ষত। তাদের ঘিরে বসে আছেন স্বজনরা।


আরও পড়ুন: চুরির অভিযোগ এনে কী হচ্ছে পাবনায়?


এ সময় আহত রাকিব হোসেন বলেন, ‘আজাদের দোকানে আমরা নিয়মিত কেরাম খেলি। রোববার রাতেও বাজারে ছিলাম। এরপর রাত ১১টার দিকে নন্দলালপুর ইউনিয়নে খালাদের বাড়ি গেছিলাম। পরে রাত ২টার দিকে হঠাৎ আজাদ বারবার বিভিন্ন নাম্বার দিয়ে কল দিতে থাকেন। পরে আমরা বাড়িতে গেলে আজাদ, তার চাচাতো ভাই মিজান, হাসানসহ অনেকেই আমাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বাজারে যান। সেখানে ফজরের আজান পর্যন্ত বাঁশের লাঠি এবং কাঠের বাটাম দিয়ে ব্যাপক মারধর করে আটকে রাখেন।’


আহত সাইফ হোসেন বলেন, ‘আমরা চুরি করিনি। তবুও সন্দেহ করে হাতে, পায়ে, পিঠে সবখানে সারারাত প্রচুর মারছে ওরা। পরে সকালে করিম মেম্বার সালিশে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করলে ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করে ছাড়া পাই।’


এ বিষয়ে সাইফের মা পলি খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে চুরি করেনি। তবুও অমানবিকভাবে মারছে। চিকিৎসা করার জন্য জরিমানা মেনে নিয়ে অগ্রিম ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করে ছেলেকে নিয়ে প্রথমে বাড়ি এবং পরে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। আমরা এর বিচার চাই। কিন্তু করিম মেম্বররা তো প্রভাবশালী। আমাদের বিচার করে দেবে কে।’


রাকিবের মা শারমিন বলেন, ‘আমরা থানায় যাব। মামলা করব। এমন মারা কেউ মারে!’


আরও পড়ুন: জামালপুরে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত যুবক, মায়ের আহাজারি


বিকেলে তারাপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আজাদের দোকান বন্ধ। বাজারে সুনসান নীরবতা। দোকানের সামনেই আজাদের বসতবাড়ির। তিনি ওই এলাকার সাজাহান শেখের ছেলে।


তবে এ ঘটনার পর  অভিযোগ অস্বীকার করে দোকানদার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দাদি মারা যাওয়ার খবর শুনে সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করে চলে যাই। রাত ১১টার দিকে ফিরে দেখি পিছনের দরজা খোলা। ড্রয়ারে ৫৫ হাজার টাকা নেই, কিছু সিগারেট ও অন্যান্য মালামাল নেই। পরে খোঁজ নিয়ে রাকিব ও সাইফের প্রতি সন্দেহ হয়। এরপর সবাই মিলে ওদের ডেকে বাজারে আনলে উৎসুক জনতা মারধর করে।’


তিনি আরও বলেন, ‘মারধরের পর ওরা চুরির কথা স্বীকার করলে বিএনপি নেতা করিম সকালে সালিশ বসিয়ে সমাধান করেন। সালিশে ১৫ হাজার টাকা করে দুজনকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একজন ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। তা করিমের কাছে আছে।


তবে এ বিষয়ে বাজারের কোনো দোকানদার এবং স্থানীয়রা কোনো কথা বলতে রাজি হননি।


আরও পড়ুন: গাইবান্ধায় গরু চোর সন্দেহে জনতার পিটুনিতে নিহত ৩


আর অভিযোগ অস্বীকার করে জগন্নাথপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল করিম বিশ্বাস (মেম্বর) বলেন, ‘চোরকে গণপিটুনি দিয়ে জনগণ আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এনেছিল। আমি তাদের এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছি। তবে সালিশ করিনি।’


তিনি আরও বলেন, ‘শুনেছি ৩৭ হাজার টাকা চুরি হয়েছে। ৩০ হাজার টাকায় মিটমাট হয়েছে।’


যেকোনো ঘটনায় আইন হাতে তুলে নেয়া উচিত নয় বলে জানিয়েছেন কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার জিয়াউর রহমান।


তিনি বলেন, ‘চুরির ঘটনায় মারধরের কথা শুনেছি। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন