মান্ধাতার আমলের কাঠের ঘানি, ভারী পাথর আর জোড়াতালি দেয়া হাতলই এখন তাদের জীবিকার একমাত্র ভরসা। প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত টিনশেডের জরাজীর্ণ ঘরের ভেতর স্বামী-স্ত্রী মিলে ঘাম ঝরিয়ে টানেন ঘানি। বাজার থেকে কেনা ৫ কেজি সরিষা দিয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা টানা পরিশ্রমের পর হাতে আসে মাত্র দেড় কেজি তেল। বিক্রি করে যা সামান্য লাভ হয়, তাই দিয়েই চলে তাদের সংসার। কিন্তু কোনো দিন তেল বিক্রি না হলে না খেয়েই কাটে দিন।
মোস্তাকিন আলীর ভাষায়, ‘ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ঘানি টানতাম। এখন প্রায় ২৪ বছর ধরে বুক দিয়ে ঘানি টেনে সংসার চালাচ্ছি। কিন্তু বয়সের কারণে শরীর আর সায় দেয় না, হাঁপিয়ে যাই। যদি কেউ একটা গরু কিনে দিত, তাহলে আবার গরু দিয়েই ঘানি টানতে পারতাম। এখন গরু কেনার সামর্থ্য নেই, তাই বুক দিয়েই টানতে হয়।’
তার স্ত্রী ছকিনা বেগম বলেন, ‘বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে ঘানি টানি। এখন বয়স হয়েছে, শরীরেও আর শক্তি নেই। তিনবেলা ঠিকমতো খাবারও জোটে না। একটা গরু পেলে কষ্টটা অনেকটা কমে যেত।’
আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে মোস্তাকিনের সংসার ছিল ছোট হলেও সচ্ছল। গরু দিয়েই চলত ঘানি। কিন্তু বড় মেয়ের বিয়েতে যৌতুকের চাপ ও খরচ মেটাতে দেনার জালে জড়িয়ে পড়েন। শেষমেশ বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে হয় ঘানি টানা গরুটি। সেই থেকেই শুরু হয় তাদের বুক দিয়ে ঘানি টানার অমানবিক জীবন।
আরও পড়ুন: ৩৫ সেকেন্ডের ঝড়ে লন্ডভন্ড নীলফামারী, ঘরে ঘরে কান্নার রোল
স্থানীয় বাসিন্দা সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আমরা এই দৃশ্য দেখে আসছি। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও তারা বুক দিয়ে ঘানি টেনে তেল বানান। তারা এলাকায় সবচেয়ে গরিব মানুষ। মাঝে মাঝে গ্রামের মানুষ সাহায্য করে, কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল।’
প্রতিবেশী জমির উদ্দিন বলেন, ‘কেউ যদি তাদের একটা গরু কিনে দিত, তাহলে অনেক কষ্ট লাঘব হতো।’
দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে বুক দিয়ে ঘানি টানার পরও মোস্তাকিন-ছকিনা দম্পতির ভাগ্যের চাকা ঘুরেনি। তাদের নিজের জমি বলতে আছে শুধু ছোট্ট একটি ভিটে। টিনের চাল ছিদ্র হয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে ঘরের ভেতর। তবুও এখন পর্যন্ত তারা কোনো সরকারি সহায়তা বা অনুদান পাননি।
এভাবেই দারিদ্র্যের নির্মম ঘানি টেনে চলেছেন মোস্তাকিন আলী ও তার স্ত্রী ছকিনা বেগম। তাদের একটাই আশা কোনো একদিন হয়তো সহানুভূতির হাত বাড়াবে কেউ, আর জীবনের এই অবসানহীন কষ্ট কিছুটা হলেও কমে যাবে।
]]>