এলিয়েন (Alien) বা মহাজাগতিক প্রাণী বলতে বোঝায় সেইসব প্রাণ বা জীবন, পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহ, উপগ্রহ বা মহাজাগতিক বস্তুতে বিদ্যমান। এটি সরল এককোষী জীব থেকে শুরু করে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও উন্নত সভ্যতা পর্যন্ত যেকোনো কিছুই হতে পারে। এটা শুধুই একটা ধারণা বিজ্ঞানীদের।
বর্তমানে পৃথিবীর বাইরে কোনো প্রাণের অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মহাবিশ্বের বিশালতা ও মহাজাগতিক রসায়নের ভিত্তিতে পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা অত্যন্ত সম্ভব।
জরিপে দেখা যায়, বেশিরভাগ বিজ্ঞানী, বিশেষ করে অ্যাস্ট্রোবায়োলজিস্টরা (মহাজাগতিক জীববিজ্ঞানী), দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রাথমিক পর্যায়ের হলেও প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। কিছু বিজ্ঞানী বুদ্ধিমান এলিয়েনের অস্তিত্বের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেন না।
আরও পড়ুন: ইসলামি বইমেলায় শিশুদের জন্য বিশেষ আয়োজন
বিজ্ঞানী কার্ল সাগান ও স্টিফেন হকিংসহ অনেকে এই যুক্তিতে বিশ্বাসী। এই নীতি অনুসারে, পৃথিবী মহাবিশ্বের কোনো অনন্য বা বিশেষ স্থানে নেই। পৃথিবীর মতোই জীবন ধারণের উপযোগী বহু গ্রহ থাকতে পারে।
এটি হলো একটি বৈপরীত্য। একদিকে যেমন প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনা খুব বেশি, তেমনি অন্যদিকে কেন বুদ্ধিমান এলিয়েনদের কোনো নিশ্চিত প্রমাণ বা সংকেত এখনো পাওয়া যায়নি, এই প্রশ্নটিই হলো 'ফার্মি প্যারাডক্স'। এটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা নানা মত দিয়েছেন। হতে পারে বুদ্ধিমান প্রাণীর জীবনকাল খুব ছোট, অথবা তারা ভিন্ন কোনো কারণে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে।
অ্যাস্ট্রোবায়োলজিও একটা শাখা বিজ্ঞানের। এই বিজ্ঞান শাখায় পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সন্ধান করা হয়। এই অনুসন্ধান থেকেই জানা যায় যে, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্বন এবং জলের মতো উপাদান মহাবিশ্বের সর্বত্রই পাওয়া যায়।
এলিয়েন নিয়ে কোরআন হাদিসের তথ্য
কোরআন বা হাদিসে সরাসরি 'এলিয়েন' বা পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। তবে ইসলাম ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে এমন কিছু আয়াত রয়েছে, মহাবিশ্বের বিশালতা, বহু জগত সৃষ্টি আর সেগুলোতে প্রাণী ছড়িয়ে থাকার ধারণাকে সমর্থন করে।
কোরআনের একাধিক আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে যে আল্লাহর সৃষ্টি শুধু পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ নয়, বহু জগতে প্রাণী ছড়িয়ে থাকার ইঙ্গিত কোরআন থেকে পাওয়া যায়,
আর তার নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি এবং এ দু'য়ের মধ্যে তিনি যে জীবজন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর যখন ইচ্ছে করবেন, তিনি তাদের একত্রিত করতেও সক্ষম। (সুরা আশ-শুরা ২৯)
তাফসিরবিদগণ এই আয়াতে উল্লিখিত ‘জীবজন্তু’ (দাব্বাহ) শব্দটি দ্বারা মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহে বা জগতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত দেন।
সাত আকাশ এবং সাত পৃথিবীর ধারণাও বিজ্ঞানীরা কোরআন থেকে পেয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে বলেন,
আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সাত আকাশ এবং সেই সাথে সাতটি পৃথিবীও। সেগুলির মধ্যে আল্লাহর নির্দেশ অবতীর্ণ হয়, যেন তোমরা জানতে পারো যে, আল্লাহ্ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান এবং আল্লাহ্ তার জ্ঞান দিয়ে সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। (সুরা আত-তালাক ১২)
এই আয়াতটি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। কেউ কেউ মনে করেন, সাত পৃথিবী দ্বারা পৃথিবীর মতো আরও গ্রহ বা জগৎকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে আল্লাহর নির্দেশ বা বিধান নাজিল হয়।
সৃষ্টির কর্তা জগতের প্রতিপালক। সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের (বিশ্বজগতের) প্রতিপালক আল্লাহরই। (সুরা আল-ফাতিহা: ১)
কুরআনে আল্লাহকে বারবার রাব্বুল আলামীন বা জগতের প্রতিপালক (Lord of the worlds) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আলামীন শব্দটি বহুবচন, যা কেবল মানব, ফেরেশতা ও জিন ছাড়াও আল্লাহর আরও অসংখ্য সৃষ্টি বা জগতকে বোঝাতে পারে।
আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, যা মানুষ জানে না
আর তিনি সৃষ্টি করেন এমন সব কিছু, যা তোমরা জান না। (সুরা আন-নাহল: ৮)
এই আয়াতটি ইঙ্গিত করে যে মহাবিশ্বে এমন অনেক সৃষ্টি ও প্রাণী আছে, যা মানুষের জ্ঞানের বাইরে। মহাবিশ্বের বিশালতা ও উদ্দেশ্যপূর্ণ সৃষ্টি। নিশ্চয়ই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের পরিবর্তনে চিন্তাশীলদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে। (সুরা আলে ইমরান: ১৯০)
এই আয়াত মানুষকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে উৎসাহিত করে, যা পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে উৎসাহিত করে।
কোরআনের পাশাপাশি হাদিস থেকেও আমরা এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা পাই। রসুলুল্লাহ সা. বলেন,
আল্লাহ তায়ালা এক লাখ আশি হাজার (১৮০,০০০) জগত সৃষ্টি করেছেন, এর মধ্যে এই দুনিয়া কেবল এক জগত। (তাফসিরে ইবনে কাসির, সূরা ফাতিহা ব্যাখ্যা, ইমাম কুরতুবি কর্তৃক উদ্ধৃত; আল-হাকিম, দুরুসুল আরাবিয়া, তাবারানি)
এই হাদিসটি সরাসরি মহাজাগতিক প্রাণের কথা না বললেও ১৮০,০০০ জগত-এর কথা বলে, যা আল্লাহর সীমাহীন সৃষ্টিশক্তি ও বহু জগতের অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয় সম্ভবত এমন জগতও, যেখানে জীবন থাকতে পারে।
তাছাড়াও মানুষ যা জানে না, তেমন অনেক কিছুই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। রসুলুল্লাহ সা. বলেন,
আল্লাহর সৃষ্টি এত বেশি যে, মানুষ তার সামান্য অংশও জানতে পারে না। তোমরা আল্লাহর সৃষ্টিকে নিয়ে চিন্তা করো, কিন্তু আল্লাহর সত্তা নিয়ে চিন্তা করো না। (সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৭২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ১৭৭০৪)
এই হাদিসে নবী সা. মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ নিয়ে চিন্তা করতে উৎসাহিত করেছেন, যা মহাবিশ্ব, নক্ষত্র, গ্রহ, এবং সম্ভাব্য জীবনের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
পৃথিবীতে এলিয়েন আছে কিনা, সেই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর কোরআন-হাদিস দেয় না। তবে ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে এমন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ্র সৃষ্টি কেবল পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ নয়। বরং মহাজাগতিক প্রাণীর ধারণা ইসলামী ধর্মতত্ত্বের মূলনীতির সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আরও পড়ুন: নবীজির প্রিয় ও পছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে সিরাতের বই ‘নবীজির প্রিয় ১০০’
আল্লাহর জগতের প্রতিপালক উপাধি এবং আকাশমণ্ডলে জীবজন্তু ছড়িয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত বিজ্ঞানীদের মহাজাগতিক প্রাণের অনুসন্ধানের ধারণাকে সমর্থন করে। এই বৃহত্তর ছবিতে, এলিয়েন হলো আল্লাহর অসীম সৃষ্টিশক্তির এক প্রমাণ। এলিয়েনদের অস্তিত্ব আবিষ্কার হলে তা ইসলামের মূল বিশ্বাসের কোনো পরিবর্তন করবে না।
এলিয়েন হলো পৃথিবীর বাইরের জীবন। বিজ্ঞানীরা সরাসরি প্রমাণ না পেলেও, তাদের অস্তিত্বকে অত্যন্ত সম্ভাব্য মনে করেন। মহাবিশ্বের বিশালতা ও রাসায়নিক উপাদানের প্রাচুর্য এই ধারণাকে সমর্থন করে। ইসলাম ধর্ম এলিয়েনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না। কোরআনের একাধিক আয়াতে অন্যান্য জগতে প্রাণ ও সৃষ্টি ছড়িয়ে থাকার ইঙ্গিত আছে।
বিশেষত সুরা শুরার:২৯ আয়াতে জীবজন্তু ছড়িয়ে থাকার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামে আল্লাহকে জগতের প্রতিপালক হিসেবে বারবার বলা হয়েছে। এটি আল্লাহর সীমাহীন সৃষ্টিশক্তির পরিচায়ক। তাই, এই বিষয়ে বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে কোনো বড় সংঘর্ষ দেখা যায় না। প্রকৃত জ্ঞান কেবল আল্লাহর কাছেই রয়েছে।
]]>