৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর ১৩ সেপ্টেম্বর নবনির্বাচিতরা দায়িত্ব নেন। এর পর থেকে নানা পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আর্থিক সংকট ও প্রশাসনিক জটিলতা।
তহবিল ছাড়াই চলছে কাজ
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ডাকসু ও হল সংসদ ফি হিসেবে অর্থ আদায় করা হলেও ডাকসুর নামে কোনো ব্যাংক হিসাব নেই। ফলে এ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ের অংশ হিসেবে ধরা হয়। নির্বাচনের পরও ডাকসুর জন্য পৃথক তহবিল গঠন করা হয়নি।
পরিবহন সম্পাদক আসিফ আব্দুল্লাহ সময় অনলাইনকে বলেন, ‘‘১৩ সেপ্টেম্বর আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। এরপর একটা বড় সময় পূজার ছুটিতে কেটেছে। অনেক পরিকল্পনা করা হলেও আনুষ্ঠানিকতার জন্য আটকে আছে।’’
আমরা এখন পর্যন্ত ডাকসু থেকে এক টাকাও পাইনি। বসার জায়গাটাও এখনও প্রস্তুত না। যেকোনো কিছু করতে গেলে ফান্ডটাই তো একটা বড় বিষয়।
তবুও ডাকসুর উদ্যোগে শূন্য তহবিল নিয়ে বেশ কিছু কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাস ট্র্যাকিং অ্যাপের ট্রায়াল, শাটল বাসের সংখ্যা ৪ থেকে বাড়িয়ে ১২টি করা এবং শাটল সেবা ২০টিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা।
স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক এম. এ. আল মিনহাজ জানান, গত এক মাসে জগন্নাথ ও শামসুন্নাহার হলে হেলথ ক্যাম্প আয়োজন করা হয়েছে। প্রতি মাসেই এ ধরনের ক্যাম্প চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি আরও জানান, মর্তুজা মেডিকেল সেন্টারে প্রায় ৩ কোটি টাকার সরঞ্জাম আনার জন্য একটি এনজিওর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। ইবনে সিনার সঙ্গে যৌথভাবে ফাস্ট এইড ট্রেনিং ও স্বাস্থ্য ছাড় কর্মসূচি চালুর প্রস্তুতিও প্রায় শেষ।
এছাড়া ক্যাম্পাসে ওষুধি গাছের বাগান, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ক্যাম্প, ফার্মেসি স্থাপন ও মেডিকেল সেন্টারের অটোমেশন অ্যাপ চালুর কাজও প্রক্রিয়াধীন বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: চারুকলা ও ডাকসুর আয়োজনে বৃহস্পতিবার ‘শরৎ উৎসব’
ডাকসু ভবন নিয়ে হতাশা
ডাকসু ভবনের সংস্কার কাজে ধীরগতি নিয়ে নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
হতাশার সুরে মিনহাজ বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত আমরা অফিসটা বুঝে পাইনি। অথচ অফিসটা আগে থেকে রেডি থাকার কথা ছিল। এখন কাজ যেভাবে ধীরগতিতে এগোচ্ছে সেটা খুবই হতাশাজনক। শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছ থেকে এক মাসে কাজের ফিডব্যাক জানতে চাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সাথে এঙ্গেজ হব, প্ল্যান-পরিকল্পনা করব, সে অফিসটাই এখনও কাজের উপযোগী হয়নি।’’
তবে ভবনের জন্য বরাদ্দ ৩০ লাখ টাকার মধ্যে ৯ লাখ টাকা এয়ার কন্ডিশনার স্থাপনের বাজেট নিয়েও সমালোচনা উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে মিনহাজ বলেন, “এসি বসানো বিলাসিতা নয়, কাজের প্রয়োজন। যেহেতু বাইরে অনেক লোক বা অ্যাম্বাসির লোকেরা এখানে আসবে, অনেক প্রোগ্রাম আমরা করতে চেয়েছি; শুধু সেই পরিবেশটা তৈরি করা দরকার। ডাকসু অফিসের ওপরেই ছাদ। পুরো জায়গাটা গরম হয়ে থাকে, সিদ্ধ হিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। এক মাসে এখনও ডাকসু অফিস প্রস্তুত করতে পারেননি- এজন্য তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উল্টো শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। সেটা না করে উল্টো আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে। এটা খুবই লজ্জাজনক।’’
’’সেই বিবেচনায় আমরা চেয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো মসজিদে এসি আছে, শিক্ষকদের রুমে এসি আছে, রিডিং রুমে এসি আছে, ডাকসু কি কম গুরুত্বপূর্ণ?’’, প্রশ্ন মিনহাজের।
ডাকসুর কার্যক্রম নিয়ে কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। বেশিরভাগেরই একই অভিযোগ, তহবিল না পাওয়ার কারণে কাজ এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না।
এর মাঝেও ডাকসু ও সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ১৩ শতাধিক কর্মী নিয়ে ক্লিনিং ক্যাম্প আয়োজন, দুর্গাপূজার সময় নিরাপত্তায় পদক্ষেপ, প্রক্টোরিয়াল টিম দিয়ে ক্যাম্পাসে মাদকাসক্ত পাগল এবং ভবঘুরে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। এছাড়াও শহীদ আবরার ফাহাদের কবর জিয়ারত, ডাকসুর উদ্যোগে এশিয়া কাপের ম্যাচ বড় পর্দায় দেখানো এবং ইশারা ভাষা দিবসে মুখাভিনয় প্রদর্শনী ও কবিতা আবৃত্তি, পুঁথি গবেষক মুন্সী আব্দুল করিমের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে পুঁথি পাঠের আসরের মতো কিছু আয়োজন দেখা গেছে।
এবারের ডাকসুর সিংহভাগ সদস্যই ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট থেকে নির্বাচিতি হয়েছেন। নির্বাচনের আগে ৩৬টি ইশতেহার রেখেছিলেন তারা। প্রতি মাসে ৩টি করে ১২ মাসে এগুলো বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও প্রথম মাসে কোনো ইশতেহারই সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে কথা বলতে ডাকসুর ভিপি, জিএস এবং এজিএসের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি।
হল সংসদের কার্যক্রম
হল ইউনিয়ন নেতারাও নিজ নিজ হলে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা মূলত মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করছেন যেমন- ক্যান্টিনে খাবারের মান, আবাসনের পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদি। হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের একটি পরিত্যক্ত ক্যান্টিন পুনরায় চালু করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হলে নতুন ক্যান্টিন এবং মেস চালু করা হয়েছে। হল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মুসলিমুর রহমান জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বাজেট থেকে হলে ৫০৪টি নতুন সিলিং ফ্যানেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অর্থায়ন ১০০টি নতুন বিছানা (চৌকি) বিতরণ করেছে।
কবি জসীম উদ্দিন হলে একটি কাওয়ালি অনুষ্ঠান হয়েছে, যা হল ইউনিয়ন ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অর্থায়নে অনুষ্ঠিত হয়।
তবে কিছু কার্যক্রম সমালোচনাও সৃষ্টি করেছে। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের সাধারণ সম্পাদক এবং সূর্যসেন হলের ভিপি নিজেদের হল ক্যান্টিন ও দোকানের খাবারের মান পর্যালোচনা করে জরিমানা করেছেন। এটা তাদের এখতিয়ারে আছে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হল কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
ডাকসুর কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন হলে হলে গিয়ে পরিদর্শন করছেন এবং শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো শুনছেন। কয়েকজন হল ইউনিয়ন নেতা সময় অনলাইনকে জানিয়েছেন, এক মাসে মধ্যে সবগুলো হলে কম্পিউটার ল্যাব এবং রিডিং রুমে এয়ার কন্ডিশনার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা।
সূর্যসেন হলে এরিমধ্যে 'ইনসাফ' নামে একটি কল্যাণ সংগঠনের উদ্যোগে নতুন একটি রেফ্রিজারেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হল অ্যালামনাইদের অর্থায়নে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে একটি বাইক ওয়াশিং মেশিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বাজেট না পাওয়ায় বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্পন্সরে এবং অ্যালামনাইদের অর্থায়নে অনেক কাজ করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডাকসু এবং হল ইউনিয়ন নেতারা।
তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে মনে করছেন, বাইরে থেকে স্পন্সরের টাকা আনায় ডাকসু নেতাদের নিজস্ব স্বার্থ থাকতে পারে। অনেকে আবার ডাকসু নেতাদের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছে। তারা বলছেন, উন্নয়ন কাজের মধ্যে যদি অন্য কারো বিজ্ঞাপন হয় তাতে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, কিছু উদ্যোগ ভালো হলেও মৌলিক সমস্যা যেমন খাবারের মান, আবাসন সংকট ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণে সমস্যার দৃশ্যমান সমাধান হয়নি।
এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী আশিকুল হক বলেন,
যত পরিবর্তনই আসুক, খাবারের মান আগের মতোই আছে। এটা জরুরি বিষয়, কিন্তু এখনো সমাধান হয়নি।
আরও পড়ুন: ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট ছাপানো নিয়ে বিতর্ক, যা বললেন উপাচার্য
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবস্থান
তহবিল নিয়ে জটিলতার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সময় অনলাইনকে বলেন, ‘আমি তিন সপ্তাহের মতো দেশের বাইরে। তেমন কিছুই জানি না। ওরা এসেছিল। ওদেরকে বলেছিলাম আবেদন করতে।’’
ডাকসুর নামে গত পাঁচ বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে ফি নেয়া হয়েছে সেটা দেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,
ওরা আবেদন করেছে। আমরা অ্যাকাউন্টস বিভাগকে বলেছি বিষয়টি যাচাই করতে। কত টাকা আছে তা দেখা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টস বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, যদিও ডাকসু নির্বাচনের খরচ ডাকসুর জন্য নির্ধারিত বাজেটের অংশ নয়, তবুও নির্বাচনে বিপুল পরিমাণে খরচ হয়ে যাওয়ায় তহবিল নিয়ে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। তবে ডাকসু ভবনের সংস্কার কাজের জন্য এরইমধ্যে ৩০ লাখ টাকা অনুমোদন হয়েছে।
ডাকসু কোষাধ্যক্ষ ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এইচ এম মোশারফ হোসেন জানিয়েছেন, ডাকসুর দাপ্তরিক কাজে টুকটাক যা খরচ হচ্ছে সব নিজেদের পকেট থেকেই হচ্ছে৷ পরে বিশ্ববিদ্যালয় এটা অ্যাডজাস্ট করে নেবে।
ডাকসু নিয়ে তো আগে ভাবা হয়নি। এখন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সমাধানের চেষ্টাও করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমরা আবেদন করেছি। এখন এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খোঁজ-খবর নিয়ে ইস্যু করবেন।
বেশকিছু কার্যক্রম শুরু হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মৌলিক বিষয়গুলোর সমাধান করে উঠতে পারেনি ডাকসু এবং হল ইউনিয়ন। বেশিরভাগ হলেরই খাবারের মান আগের মতোই রয়ে গেছে। এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী আশিকুল হক বলেন, 'যত পরিবর্তনই আসুক, খাবারের মান সেই আগের মতোই থেকে যায়। এটা সমাধান করা জরুরি।' আবাসন সমস্যা, ক্যাম্পাসের যানবাহন নিয়ন্ত্রণসহ মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানেও ডাকসুর পক্ষ থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি এখন পর্যন্ত।

২ সপ্তাহ আগে
৬








Bengali (BD) ·
English (US) ·