হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
ইতিহাসে যুদ্ধ ও শান্তি পাশাপাশি পথে চলেছে। একদিকে ছিল জুলুম ও শক্তির দম্ভ, আরেক দিকে ছিল ইনসাফ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। আরবের জাহেলি যুগেও দেখা যায় এই দ্বন্দ্বের চিত্র। মক্কার রক্তক্ষয়ী ফিজার যুদ্ধের পরই জন্ম নেয় হিলফুল ফুজুল।
ফিজার যুদ্ধের ভয়াবহতা চিন্তাশীল আরববাসীকে দারুণভাবে বিচলিত করে তোলে। এ যুদ্ধে কত যে প্রাণহানি ঘটে, কত শিশু এতিম হয়, কত নারী বিধবা হয় এবং কত সম্পদ বিনষ্ট হয়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই! ভবিষ্যতে আরববাসীদেরকে যাতে এরকম অর্থহীন যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে না হয়, সেজন্য আরবের বিশিষ্ট গোত্রপতিরা আব্দুল্লাহ বিন জুদয়ান তাইমির গৃহে একত্রিত হয়ে মহান আল্লাহর নামে একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদনা করেন। আব্দুল্লাহ বিন জুদয়ান ছিলেন তৎকালীন মক্কার একজন অত্যন্ত ধনাঢ্য ব্যক্তি। অধিকন্তু সততা, দানশীলতা এবং অতিথিপরায়ণতার জন্য সমগ্র আরবে তার বিশেষ প্রসিদ্ধি থাকার কারণে আবরবাসীর উপর তার যথেষ্ট প্রভাবও ছিল। এ প্রেক্ষিতেই তার বাড়িতে অঙ্গীকারনামা সম্পাদনের এ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়।
যে সকল গোত্র আলোচনা-বৈঠকে অংশগ্রহণ করে তার মধ্যে প্রধান গোত্রগুলো হচ্ছে বনু হাশিম, বনু মুত্তালিব, বনু আসাদ বিন আব্দুল উযযা, বনু যুহরা বিন কিলাব এবং বনু তামিম বিন মুররাহ। বৈঠকে একত্রিত হয়ে অন্যায়, অনাচার এবং অর্থহীন যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রতিকার সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করেন। তখনকার সময়ে নিয়ম ছিল গোত্রীয় কিংবা বংশীয় কোনো ব্যক্তি, আত্মীয়-স্বজন অথবা সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ কোনো ব্যক্তি শত অন্যায়-অনাচার করলেও সংশ্লিষ্ট সকলকে তার সমর্থন করতেই হবে-- তা সে যত বড়ো বা বীভৎস অন্যায় হোক না কেন।
আরও পড়ুন: নারীদের নিয়ে সুরা নিসায় যেসব বিধান রয়েছে
বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়
এ পরামর্শসভায় এটা স্থিরী হয় যে, এ জাতীয় নীতি হচ্ছে ভয়ংকর অন্যায়, অমানবিক ও অবমাননাকর। কাজেই এ ধরনের জঘন্য নীতি আর কিছুতেই চলতে দেয়া যেতে পারে না। তারা প্রতিজ্ঞা করলেন :
(ক) দেশের অশান্তি দূর করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
(খ) বিদেশি লোকজনের ধন-প্রাণ ও মান-সম্মান রক্ষা করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
(গ) দরিদ্র, দুর্বল ও অসহায় লোকদের সহায়তাদানে আমরা কখনোই কুণ্ঠাবোধ করব না।
(ঘ) অত্যাচারী ও অনাচারীর অন্যায়-অত্যাচার থেকে দুর্বল দেশবাসীদের রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করব।
এটা ছিল অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকারনামা।
এজন্য এ অঙ্গীকারনামাভিত্তিক সেবা সংঘের নাম দেয়া হয়েছিল ‘হিলফুল ফুযুল’ বা ‘হলফ-উল ফুযুল’।
একদা এ প্রসঙ্গের উল্লেখকালে নবীজি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন,
আজও যদি কোনো উৎপীড়িত ব্যক্তি বলে, হে ফুযুল অঙ্গীকারনামার ব্যক্তিগণ! আমি নিশ্চয়ই তার সে আহবানে সাড়া দেব।
এ ব্যাপারে অন্য এক প্রসঙ্গে নবীজি বলেছিলেন,
আব্দুল্লাহ বিন জুদআনের বাসভবনে আমি এমন এক অঙ্গীকারনামায় শরিক ছিলাম, যার বিনিময়ে আমি আসন্ন প্রসবা উটও পছন্দ করি না এবং যদি ইসলামের যুগে এরূপ অঙ্গীকারের জন্য আমাকে আহবান জানানো হয়, তাহলেও আমি উপস্থিত আছি কিংবা প্রস্তুত আছি বলতাম। (মুখতাসারুস সিরাহ, পৃ. : ৩০-৩১)
সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
‘হিলফুল ফুজুল’ প্রতিষ্ঠার অন্য একটি প্রাসঙ্গিক প্রত্যক্ষ পটভূমির কথাও জানা যায় এবং তা হচ্ছে, জুবাইদ নামক একজন লোক মক্কায় এসেছিলেন কিছু মালপত্র নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে। আস বিন ওয়ায়িল সাহমি তার কাছ থেকে মালপত্র ক্রয় করেন কিন্তু তার প্রাপ্য তাকে না দিয়ে তা আটকে রাখেন। এ ব্যাপারে তাকে সাহায্যের জন্য তিনি আব্দুদ্দার, মাখযুম, জুমাহ, সাহম এবং আদি এ সব গোত্রের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। কিন্তু তার আবেদনের প্রতি কেউই কর্ণপাত করেনি। তাই তিনি জাবালে আবু কুবাইশ পর্বতের চূড়ায় উঠে উচ্চকণ্ঠে কিছু কবিতা আবৃত্তি করেন, যার মধ্যে তার নিজের অত্যাচার-উৎপীড়নের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টিও বর্ণিত ছিল।
আরও পড়ুন: মৃত মা-বাবাকে স্বপ্নে দেখলে করণীয়
আবৃত্তি শোনার পর যুবায়ের বিন আব্দুল মুত্তালিব দৌড়ে গিয়ে বলেন,
এ লোকটি অসহায় এবং সহায়-সম্বলহীন কেন?
তখন জুবাইরের প্রচেষ্টায় উপরোক্ত গোত্রগুলো একত্রিত হয়ে একটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন এবং পরে আস বিন ওয়ায়িলের নিকট থেকে জুবাইরের পাওনা আদায় করে দেয়া হয়। (মুখতাসারুস সিরাহ, পৃ. : ৩০-৩১)
]]>
১ সপ্তাহে আগে
৪








Bengali (BD) ·
English (US) ·