স্বর্ণে বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ?

১ সপ্তাহে আগে
বিশ্ব অর্থনীতি এখন এক অস্বস্তিকর সমীকরণে আটকে আছে। মূল্যস্ফীতির চাপ, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, ডলার নির্ভরতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ-সব মিলিয়ে বাজারজুড়ে অনিশ্চয়তা। এই পটভূমিতে স্বর্ণ আবারও উঠে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রশ্ন-এই উথালপাথালে স্বর্ণে বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ?

প্রাচীনকাল থেকেই প্রাচুর্যের অপর নাম স্বর্ণ। একে বলা হয়, অর্থের সবচেয়ে স্থায়ী রূপ। হাজার বছর ধরে মূল্যবান এই ধাতুর চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য, দীপ্তি আর চাকচিক্য মানুষকে অভিভূত করে চলেছে।


তাই প্রাচীনকাল থেকেই অন্যান্য ধাতুর চেয়ে স্বর্ণের দাম কয়েকগুণ বেশি। সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মানুষ তার নিজ প্রয়োজনে নানা ধাতু আবিষ্কার করেছে। স্বর্ণ সেসব আবিষ্কারের একটি। স্বর্ণতো নিজের দাম নিজে ঠিক করেনি। এগুলো তখনই মূল্যবান হয়ে উঠেছে যখন সমাজ একে মূল্যবান বা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। অর্থাৎ চূড়ান্ত বিচারে স্বর্ণ বা অন্য কোনো জিনিসের মূল্য মূলত সামাজিকভাবে সৃষ্ট।


স্বর্ণ দামি বা মূল্যবান; কারণ আমরা সমাজগতভাবে মনে করি, এর মূল্য অতীতে যেমন ছিল, আগামীতেও থাকবে। আর এই প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে মানুষ স্বর্ণ রিজার্ভ করতে থাকে। যার প্রভাবও পড়ে স্বর্ণের বাজারে।

 

আরও পড়ুন: কোনদিকে যাচ্ছে স্বর্ণের বাজার?
 

ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয়- দুই পর্যায়েই স্বর্ণ জমিয়ে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। কারণ এটি এমন এক বিনিয়োগ যাতে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কা থাকে না। অর্থনীতির দুর্দিনে মানুষ স্বর্ণ কেনার দিকে ঝুঁকে পড়ে। অর্থের মূল্য ধরে রাখা যায় না, তবে স্বর্ণ কিনে রাখা লাভজনক কারণ এর মূল্য কমার চেয়ে বাড়ার প্রবণতাই বেশি।


অস্থির বাজারে ‘নিরাপদ আশ্রয়’ স্বর্ণ


গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম লাগাতার উত্থান-পতন চলেছে। সবশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম দাঁড়িয়েছে ৩,২৩০ ডলার, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ-নীতি ঘিরে বাজারে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তার জেরেই বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন স্বর্ণের দিকে।


রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতি, বিশেষ করে চীনের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপের হুমকি-আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এর ফলে শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি সরে যাচ্ছে স্বর্ণ ও অন্যান্য কমোডিটিতে।


অর্থনীতিবিদ ও মার্কেট বিশ্লেষক ক্লাইড রাসেল বলছেন, 'ট্রাম্পের নীতিগত অনিশ্চয়তা যেমন বাজারে ধাক্কা দিয়েছে, ঠিক তেমনি স্বর্ণ তার ঐতিহ্যিক নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কার্যকর হয়েছে।'


উইজডমট্রির পণ্য কৌশলবিদ নীতেশ শাহ বলেন, ’ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বিপর্যস্ত বিশ্বে স্বর্ণ স্পষ্টতই বিনিয়োগকারীদের পছন্দের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে দেখা হচ্ছে। মার্কিন ডলারের দাম কমেছে এবং মার্কিন ট্রেজারিগুলো ব্যাপকভাবে বিক্রি হচ্ছে, কারণ নির্ভরযোগ্য বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আস্থা কমে গেছে।‘


ট্রাডু ডট কমের সিনিয়র বাজার বিশ্লেষক নিকোস জাবোরাস বলেন, ‘স্বর্ণ তার নিরাপদ আশ্রয়স্থলের আকর্ষণ ফিরে পেয়েছে এবং দাম নতুন করে সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।’


আর ক্যাপিটাল ডটকমের আর্থিক বাজার বিশ্লেষক কাইল রোডা বলেন, ‘বিশ্ববাজারে ফের বাড়ছে স্বর্ণের দাম। এখন এটি প্রতি আউন্স ৩ হাজার ৫০০ ডলার ছাড়ানোর অপেক্ষায়।’


কেন বাড়ছে আগ্রহ?


বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে স্বর্ণ একটি ‘সেফ হ্যাভেন’ বা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কাজ করছে।


বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস সম্প্রতি পূর্বাভাস দিয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে চলতি বছরের শেষ দিকে স্বর্ণের দাম ৩,৭০০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। একইসঙ্গে এই প্রতিষ্ঠান বলেছে, স্বর্ণ এখন শুধু নিরাপদ নয়, বরং লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

 

আরও পড়ুন: ক্রমশ ধরাছোঁয়ার বাইরে যাচ্ছে স্বর্ণের দাম!


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘গোল্ড রিজার্ভ’ রূপ নিচ্ছে কৌশলে


শুধু ব্যক্তি বিনিয়োগকারীই নয়, বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বিপুল পরিমাণে স্বর্ণ কিনেছে। এই প্রবণতা ২০২৫ সালেও অব্যাহত আছে।


বিশেষ করে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবিরতভাবে স্বর্ণ কিনছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন এখন মার্কিন ডলার নির্ভরতা থেকে মুক্ত হতে চায়। তারা স্বর্ণে রিজার্ভ বাড়িয়ে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক লেনদেনে বিকল্প ভিত্তি তৈরি করতে চায়।


এই প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আগ্রহের ফলে স্বর্ণের বাজারে যে চাহিদা তৈরি হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদে এর দামে ঊর্ধ্বমুখী চাপ বজায় রাখবে।


স্বর্ণ কি শুধু নিরাপত্তা, না কি স্মার্ট বিনিয়োগ?


যদিও বহুদিন ধরেই স্বর্ণ ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে পরিচিত, তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটিকে অনেকে ‘স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট’ হিসেবেও দেখছেন। কারণ এর চাহিদা যেমন স্থিতিশীল, তেমনি মূল্যও দীর্ঘমেয়াদে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।


তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—এই বাজারেও ঝুঁকি আছে। যদি হঠাৎ করে বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যায়, বা যুক্তরাষ্ট্র সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, তাহলে স্বর্ণের দামে হঠাৎ পতন ঘটতেও পারে।


বাংলাদেশি প্রেক্ষাপট: বিনিয়োগের সুযোগ না বিপদ?


বাংলাদেশেও স্বর্ণ দীর্ঘদিন ধরেই মূল্য সংরক্ষণের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্থানীয় বাজারেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এরমধ্যেই দেশে স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার ওপরে উঠেছে।


বিনিয়োগকারী ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে চাইলে বাজার পরিস্থিতি বুঝে ধাপে ধাপে এগোনো উচিত। বিশেষ করে যেহেতু স্বর্ণে তাৎক্ষণিক লভ্যাংশ মেলে না, তাই এটি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করলেই ভালো।


বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিংয়ের চেয়ারম্যান ও বাজুস সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান সময় সংবাদকে বলেন, চলমান যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধসহ বেশ কয়েকটি কারণে মূলত বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ছে। ট্রাম্পের শুল্কারোপের পর রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছানোর পর হঠাৎ করেই স্বর্ণের দামে বড় পতন হয়েছিল। তবে ট্রাম্প চীন বাদে অন্যান্য দেশের ওপর আরোপিত শুল্ক ৩ মাসের জন্য স্থগিত করায় ফের বাড়ছে দাম। যা এরই মধ্যে ৩ হাজার ২০০ ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। এছাড়া ফেডের সুদের হার, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও নানা অস্থিরতায় অস্থির স্বর্ণের বাজার।

 

আরও পড়ুন: পতন ঠেকিয়ে বিশ্ববাজারে ফের রেকর্ড উচ্চতায় স্বর্ণের দাম


এ অবস্থা চলমান থাকলে খুব শিগগিরই বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ৩ হাজার ৩০০ ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করবে বলেও জানান মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে মানুষ বিনিয়োগের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছেন। এ অবস্থা চলমান থাকলে ৩ হাজার ৫০০ ডলার প্রতি আউন্সও অতিক্রম করতে পারে। তবে সেটি নির্ভর করছে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর।


দেশের বাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে মাসুদুর রহমান বলেন, চলমান অস্থিরতায় চলতি বছর দেশের বাজারে এখন পর্যন্ত ১৫ বার দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে দাম পৌঁছেছে ১ লাখ ৬০ হাজারের ওপরে। এ অবস্থা জারি থাকলে চলতি বছর স্বর্ণের ভরি ২ লাখের কাছাকাছি চলে যেতে পারে, আবার ২ লাখ টাকার মাইলফলকও অতিক্রম করতে পারে।


তবে স্বর্ণের দামের ঊর্ধ্বমুখীতায় দেশের বাজারে ৭০-৮০ শতাংশ বেচাকেনা কমে গেছে বলেও জানান তিনি। মাসুদুর রহমান বলেন, দাম বাড়ায় সব দেশেই বেচাবিক্রি কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারেও।


বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিনিয়োগের বিকল্প সংকোচনের এই সময়ে স্বর্ণ তার ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা আবারও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। যদিও প্রতিটি বিনিয়োগের মতো এটিতেও ঝুঁকি আছে, তবে সঠিক সময়ে, পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ করলে স্বর্ণ হতে পারে এক নির্ভরযোগ্য সঙ্গী।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন