স্ত্রীকে ফোন করে বলি, ‘আমি হয়তো আর বাঁচব না, ক্ষমা করো’

৪ সপ্তাহ আগে
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন মেজর (অব.) মোকাররম আহম্মেদ। এ নিয়ে এই মামলায় ২৮৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের অস্থায়ী আদালতে সাক্ষ্য দেন তিনি। সাক্ষ্যে সিনেমার গল্পের মতো পিলখানা হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন মেজর (অব.) মোকাররম।


আদালতকে তিনি জানান, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নাইট শিফট শেষে অফিসার্স কোয়ার্টারে ঘুমাচ্ছিলেন মেজর মোকাররম। গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙে তার। নানান প্রশ্ন মনে জাগায় সহকর্মীদের ফোন দিয়ে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এরইমধ্যে শহীদ হয়েছেন। এ কথা শুনে তিনি বুঝতে পারেন, তারও বাঁচার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। শেষবারের মতো পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে স্ত্রীকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘আমি হয়তো আর বাঁচব না। আমাকে ক্ষমা করো।’


মেজর (অব.) মোকাররম জানান, উদ্ধারের আশায় কিছুটা সময় লুকিয়ে থাকতে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। খাট দিয়ে দরজায় ব্যারিকেড তৈরি করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিডিআর সদস্যরা এসে দরজা লাথি দিয়ে খোলার চেষ্টা করেন। প্রাণভয়ে টয়লেটে লুকিয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু দরজা ভেঙে কক্ষে প্রবেশ করে বিডিআর সদস্যরা টয়লেট ভেতর থেকে বন্ধ দেখে বুঝতে পারেন ভেতরে কেউ লুকিয়ে আছে।


বারবার ধাক্কা দেয়ার পরও টয়লেটের দরজা না খোলায় এক বিডিআর সদস্য বলেন দরজায় গুলি করতে৷ তখন মেজর মোকাররম বলেন, ‘গুলি করার দরকার নেই। আমি বের হচ্ছি।’ বের হলে বিডিআর সদস্যরা তাকে মারতে মারতে বলেন, ‘বের হতে এত দেরি করলি কেন?’ তার সঙ্গে থাকা মোবাইল, ল্যাপটপ মানিব্যাগসহ যাবতীয় সবকিছু জব্দ করেন বিডিআর সদস্যরা। এক সদস্য মেজর (অব.) মোকাররমের কপালে পয়েন্ট ব্ল্যাংকে অস্ত্র ধরে জিজ্ঞেস করেন, ‘পাশের ঘরে কারা থাকে?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এক দিন আগে এখানে এসেছি। তাই আমি জানি না।’
 

আরও পড়ুন: পিলখানা হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত, কী বলছে কমিশন?


বিডিআর সদস্যরা মোকাররমকে পাশের কক্ষে ঢুকতে বলেন। সেখানে ক্যাপ্টেন তানভির হায়দার, তার স্ত্রী-সন্তান ও গৃহকর্মীকে আলমারিতে কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে দেখেন। 


বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ানরা রুমে ঢুকে ক্যাপ্টেন তানভীরের স্ত্রীকে দেখতে পেয়ে তার চুল ধরে টেনে বের করে মারধর শুরু করেন। এ সময় তার কোলেই ছিল তার সন্তান। বাকি রুমগুলোতে আর কাউকে পায়নি তারা।


মেজর (অব.) মোকাররম জানান, ক্যাপ্টেন তানভীরের স্ত্রীকে সামনে ও তাকে পেছনে রেখে নিয়ে যাচ্ছিলেন বিডিআর সদস্যরা। পথে ক্যাপ্টেন তানভীরের স্ত্রীকে পেছন থেকে লাথি মারে হায়েনারা। টেনে ছিঁড়ে ফেলে তার গায়ের কাপড়। মেজর (অব.) মোকাররমকে রাইফেল দিয়ে বাড়ি মারতে থাকে। মারতে মারতে দুটি রাইফেল ভাঙে তারা।


রাইফেল ভাঙার বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত দাবি করে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বিডিআর সদস্য বলেন, ‘রাইফেল দিয়ে একটা বাড়ি মারমু, সোজা মাথা ফাটায়ে ফেলমু। কিন্তু রাইফেল ভাঙব না।’


মোকাররম আদালতকে জানান, একজন সৈনিক অস্ত্র তাক করে তাকে হত্যা করতে আসে। তখন তিনি বলেন, ‘আমাকে মারবা কেন?’ তারা জবাব দেয়, ‘আমরা কোনো অফিসার রাখব না।’ এরপর হত্যা না করে তাকে বন্দিশালায় রাখে। সেখানে আরও বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার বন্দি ছিলেন। জায়গাটা লোকজনে ভর্তি হয়ে এত সংকীর্ণ ছিল যে, বসার জায়গাও ছিল না।
 

আরও পড়ুন: বিডিআর হত্যাকাণ্ড: ই-মেইলে জবানবন্দি দিলেন আ. লীগের পলাতক দুই নেতা


গারদে কোনো সেনা কর্মকর্তা আছেন কি না, তা খুঁজতে আসে বিডিআরদের একটি দল। এ সময় সেনা কর্মকর্তাদের স্ত্রীরা মেজর (অব.) মোকাররমসহ তিন কর্মকর্তাকে ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখেন। কিছুক্ষণ পর একজন সৈনিক এসে আরেক সৈনিককে বলেন, ‘এদের (গারদের) সবাইকে গ্রেনেড দিয়ে একবারে মেরে ফেলি।’


মোকাররম আহম্মেদ আদালতকে বলেন, দমবন্ধ পরিবেশে সারা দিন কাটানোর পর রাত আড়াইটার দিকে পিলখানায় প্রবেশ করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও কিছু গণমাধ্যমকর্মী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন বিদ্রোহীরা। গারদখানা থেকে মাত্র ৩-৪ গজ দূরেই ঘটছিল আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। এ সুযোগে উদ্ধার পেতে দরজায় লাথি দিয়ে শব্দ করে যাচ্ছিলেন মেজর (অব.) মোকাররম। কিন্তু এক কর্মকর্তার স্ত্রী তাকে টেনে সরিয়ে এনে শব্দ করতে নিষেধ করেন। এরপর বন্দিদের খোঁজখবর না নিয়েই চলে যান সাহারা খাতুন।


তিনি জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চলে যাওয়ার পরপরই ঘটনা আবার আগের চিত্রে ফিরে আসে। সমর্পণ করা অস্ত্র আবার হাতে তুলে নেন বিডিআর সদস্যরা। সাহারা খাতুনকে দেখে শব্দ করায় বন্দিদের এসে বিডিআর সদস্যা বলেন, ‘আমাদের কথা না শোনায় মেজর মামুনকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাই আপনারাও সাবধান থাকবেন। নেক্সট টাইম এমন করলে আপনাদেরও মারা হবে।’


বর্ণনা দিতে গিয়ে একটু থেমে মেজর মোকাররম বলেন, ‘যে ভাবি আমাকে টেনে নিয়েছিলেন আমি তাকে ধন্যবাদ জানাব। কারণ, পরে আমি বুঝতে পারি, অস্ত্র সমর্পণ করা সম্পূর্ণ একটা নাটক ছিল। ওরা নিজেদের মধ্যে গর্ব করে আলোচনা করছিল, কে কাকে হত্যা করেছে।’


তিনি আরও বলেন, ‘পরদিন দুপুরে দাবি মেনে নেয়ার কথা শুনে বিডিআর সদস্যরা উল্লাস করতে থাকেন। অপরদিকে গুঞ্জন চলে, কিছু দাবি এখনও মানা হচ্ছে না। না মানলে বন্দিদের মেরে ফেলা হবে।’


মেজর (অব.) মোকাররম বলেন, ‘এর ঘণ্টা খানেক পর সন্ধ্যার আগমুহূর্তে প্রথমে সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্য পরে কর্মকর্তাদের পিকআপে করে পিলখানার চার নম্বর গেটের সামনে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। মুক্তি পেয়ে আমি হাসপাতালে ভর্তি হই।’

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন