এই স্থানটি এক সময় ছিল নির্জন সবুজ-শ্যামল। চারপাশ উঁচু-নিচু আরও কিছু টিলাভূমি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানুষকে এখানে ধরে এনে নারকীয় গণহত্যা চালিয়েছিলো পাকিস্তানি সেনারা। এই হত্যাযজ্ঞের পর থেকেই মূলত এই জায়গার নাম হয় ‘মরাটিল্লা’। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এটি ‘বধ্যভূমি ও গণকবর’ হিসেবেও পরিচিতি পায়।
এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ জানান, ১৯৭১ সালের ৮ জুন উপজেলা সদরের উপকণ্ঠে দুটি বধ্যভূমির প্রথমটিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীদের সহযোগিতায় গণহত্যা শুরু করে। এদিন মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের প্ররোচনায় বাড়ি থেকে ধরে এনে তৎকালীন ছাত্রনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আলতাফ হোসেনের বাবা বিয়ানীবাজারের নয়াগ্রামের (ফতেপুর) শহীদ মো. তাহির আলী, তার ছোট ভাই যুবনেতা শহীদ মো. আবুল হোসেন নিজাম, কসবা গ্রামের বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক শহীদ মো. আব্দুল মান্নান, মাথিউরা গ্রামের সমাজসেবক শহীদ মো. সিরাজ উদ্দিনকে প্রথমে স্থানীয় ডাক বাংলায় অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
এরপর বিকেলে চোখ বেঁধে প্রথম বধ্যভূমিতে নিয়ে যায় এবং একত্রে ব্রাশফায়ার করে একই গর্তে মাটি চাপা দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এটি ছিল উপজেলা সদরে সংঘটিত পাকবাহিনীর প্রথম গণহত্যার বর্বরোচিত ঘটনা।
আরও পড়ুন: ৫৪ বছর পরে মিলল ৫ শহীদের সমাধি
তিনি আরও জানান, এরপর থেকে পাকবাহিনী স্বাধীনতাবিরোধী এবং রাজাকার, আলবদর এবং আলসামসদের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রতিদিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী বহু মানুষ ধরে এনে থানা শহরের প্রথম এবং দ্বিতীয় আরেকটি উপজেলা প্রশাসনিক ভবনের নিকটবর্তী টিলায় বধ্যভূমিতে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ছিল। এ ছাড়া নিকটবর্তী বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিকামীদের ধরে এনে ওই বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিক উদ্দিন জানান, বিয়ানীবাজারের দুটি বড় বধ্যভূমি ছাড়াও স্বাধীনতাবিরোধীদের সহযোগিতায় পাক বাহিনীর নির্মমতার শিকার উপজেলার সর্বত্র অসংখ্য গণকবর রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের স্মরণে উপজেলা সদরের বধ্যভূমির প্রথমটিকে ১৯৮৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে উদ্বোধনের মাধ্যমে তৎকালীন সরকারের আমলে শহীদ পরিবারের সহযোগিতায় সিলেট জেলা প্রশাসন এবং উপজেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে ‘শহীদ স্মৃতিসৌধে’ রূপান্তরিত করে। এর নামকরণ করা হয় ‘বিয়ানীবাজার কেন্দ্রীয় শহীদ স্মৃতিসৌধ’।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে বিয়ানীবাজার উপজেলার পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিকামী মানুষের একমাত্র সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছিল পূর্ব মুড়িয়া এলাকায়। ওই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিতাড়িত করে পাকিস্তানী হানাদাররা দখল করে পূর্ব মুড়িয়া এলাকা। স্থানীয় রাজাকারসহ পাক বাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় মুক্তিকামী মানুষদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এনে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের শিকার হন সারপারের মো. আবদুর রহমান, নয়াগ্রামের আবদুর নুর, তেরা মিয়া, আষ্টঘরীর কুতুব আলী, ঠেকইকোনার মোবারক আলীসহ অনেকে।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারা দেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়: প্রধান উপদেষ্টা
পাক বাহিনীর নির্যাতনে নিহত হয়েছেন নয়াগ্রামের মাওলানা মকদ্দছ আলী ময়না মিয়া, সারপারের মো. এরশাদ আলী, চাতলপাড়ের আইয়ুব আলী, বড়উধার মোস্তুফা উদ্দিন চৌধুরী (রেদন মিয়া), আব্দুস সাত্তার, আবদুল গফুর, মাইজকাপন-ইনামপুরের আবদুর রউফ কুটি মিয়া (অব. ইপিআর হাবিলদার), আব্দুল মুহিত (কনাই মিয়া)। তাদের মরদেহ নয়াগ্রামের বর্তমান বিজিবিসংলগ্ন জয়নাল মেম্বারের বাড়ির সামনে সুনাই নদীর চর ও আশপাশের বিভিন্ন গর্তে এনে গণকবর দেয়া হয়।
বিয়ানীবাজার শহীদ সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ৭১ এর পক্ষ থেকে ৮ জুনকে বিয়ানীবাজার গণহত্যা দিবস এবং গণকবরগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২০১৫ সালে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবরে একটি আবেদন দেয়া হয়। কিন্তু ওই সংগঠনের দাবি আজ পর্যন্ত তার কোনো জবাব বা আবেদনের পক্ষে কোনো উদ্যোগ কর্তৃপক্ষ নেয়নি।