গাজা ও লেবাননে ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসন ও হত্যাযজ্ঞের জেরে মধ্যপ্রাচ্য উত্তাল। প্রায় ১৪ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর গত ২৭ নভেম্বর হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে ইসরাইল।
যুদ্ধবিরতির দিনই জঙ্গি গোষ্ঠী আল কায়েদা ও আইএস থেকে উদ্ভূত হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) ও আরও কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠী সিরিয়ার ইদলিব ও আলেপ্পো শহরে হঠাৎ বড় ধরনের হামলা শুরু করে।
মাত্র ১২ দিনের ঝটিকা আক্রমণে গত রোববার (৮ ডিসেম্বর) রাজধানী দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিমানে করে দেশ ছেড়ে পালান ২৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ।
এর মধ্যদিয়ে আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। অত্যাচারী একনায়কের পতনকে উদযাপন করছেন সিরীয় জনগণ। এরইমধ্যে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এই সরকারের হাতে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে- এমনটাই প্রত্যাশা সিরীয়দের।
আরও পড়ুন: চুক্তি লঙ্ঘন / সিরিয়ার গোলান মালভূমির আরও ভেতরে ইসরাইলি সেনারা
কিন্তু ইসরাইল সেই সিরিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ থাকতেই গত কয়েক বছর ধরে বিমান হামলা চালিয়ে আসছিল ইসরাইল। নতুন করে অস্থিতিশীলতার সুযোগে দেশটিতে সেই হামলা জোরদার করা হয়; যাকে ইসরাইলের বিমান বাহিনীর ইতিহাসে অন্যতম বড় হামলা বিবেচনা করা হচ্ছে।
সর্বাত্মক হামলার পাশাপাশি ইসরাইলের সেনারা দেশটির ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ছে। গোলান হাইটস ছাড়াও পার্বত্য অঞ্চল হারমন দখলে নিয়েছে। সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে তারা ‘নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণা সিরীয়দের মাঝে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
বুধবার (১১ ডিসেম্বর) প্রকাশিত আল জাজিরার এক প্রতিবেদন মতে, বুধবার পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টায় সিরিয়ার ১৪টি প্রদেশে অন্তত ৪৮০টি হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী।
রাজধানী দামেস্কের পাশাপাশি হোমস, তারতুস, পালমিরা, লাতাকিয়া, দেইর আজ জরের মতো শহরগুলোতে অবস্থিত যুদ্ধজাহাজ, বিমানঘাঁটি, সামরিক যান, বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র, অস্ত্র উৎপাদন কারখানা, অস্ত্রাগারসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা টার্গেট করেছে ইসরাইল।
আরও পড়ুন: আসাদের পতন / সিরিয়ার ৮০ শতাংশ সামরিক সম্পদ ধ্বংস করেছে ইসরাইল!
ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বুধবার (১১ ডিসেম্বর) এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘গত ৪৮ ঘণ্টায় সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানে ৪৮০টি বিমান হামলা চালানো হয়েছে। হামলার লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ১৫টি নৌযান, বিমান-বিধ্বংসী ব্যাটারি এবং বেশ কয়েকটি অস্ত্র উৎপাদন সাইট ছিল।’
আইডিএফ আরও বলেছে, সোমবার (৯ ডিসেম্বর) রাতে অর্থাৎ বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখলের পরেরদিনই সিরিয়ার আল বাইদা ও লাতাকিয়া বন্দরে হামলা চালায় তারা। সেখানে সিরিয়ার নৌবাহিনীর ১৫টি জাহাজ নোঙ্গর করা ছিল, যার সবগুলো ধ্বংস হয়েছে।
কেন এই হামলা?
সিরিয়ার সামরিক সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দিতেই এ হামলা চালানো হচ্ছে। এমনটা বলছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস।
সিরিয়া সংঘাত নিয়ে কাজ করা সংস্থাটি বলেছে, ইসরাইলের হামলায় সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সব সামরিক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ ও হেলিকপ্টার থেকে শুরু করে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন- সব ধরনের অস্ত্র ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
বুধবার ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর (আইডিএফ) বিবৃতিতে বলা হয়, বাশার আল আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ার সামরিক সরঞ্জামাদি যুদ্ধের আওতার বাইরে রাখতে অর্থাৎ সিরিয়া যাতে আর যুদ্ধ না করতে পারে সেজন্য দেশটির বিভিন্ন কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়েছে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই; কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা করা প্রয়োজন, তার সবটাই আমরা করব।’
আরও পড়ুন: আসাদ সরকারের পতনে প্রাণচাঞ্চল্য সিরিয়া, দেশে ফিরছেন শরণার্থীরা
তিনি আরও বলেন, ‘সিরিয়ার সামরিক বাহিনীর ফেলে যাওয়া কৌশলগত সামরিক সরঞ্জাম ও স্থাপনায় বোমা হামলা চালাতে বিমানবাহিনীকে অনুমতি দিয়েছি, যাতে এগুলো জিহাদিদের হাতে না যায়।’
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড ডেস রোচেস নেতানিয়াহুর কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি বলেছেন, ইসরাইল সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। কারণ সে তার নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যেকোনো হুমকি দূর করতে চায়।
আরব উপদ্বীপ বিষয়ক পেন্টাগনের সাবেক এই পরিচালক আরও বলেন, ‘২০১৩ সালে ফ্রান্স সরকারের করা এক হিসেব মতে, সিরিয়ায় প্রায় ১ হাজার টন রাসায়নিক অস্ত্র ছিল। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এসব রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসের কথা ছিল। সিরীয়রা ২০১৪ সালে জানায়, এগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু তারা ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর রাসায়নিক হামলা চালায়।’
তবে এই মুহুর্তে সিরিয়ায় কত রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেননি বিশ্লেষক রোচেস। তিনি আরও জানিয়েছেন, ইসরাইল সিরিয়ার বিমান বাহিনী ও দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার ওপর হামলা চালাচ্ছে।
আরও পড়ুন: আসাদের বাবার কবর জ্বালিয়ে দিলেন সিরিয়ার বিদ্রোহীরা
তার কথায়, ‘এর ফলে এখন সিরিয়ার মরুভূমি থেকে আইএসের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী বের হলেও তাদের রাসায়নিক অস্ত্র সরবরাহ করার ক্ষমতা থাকবে না। এবং এর পেছনে একটা অনিশ্চয়তাও কাজ করছে। ইসরাইলিরা জানে না, সিরিয়ায় কেমন সরকার হতে চলেছে। মূলত তারা তাদের কোনো সুযোগ দিতে চায় না।’
তবে কেউ কেউ ইসরাইলের এই বেপরোয়া বিমান হামলাকে সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন। লন্ডনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের মিডল ইস্ট অ্যান্ড নর্থ আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক সানাম বাকিল রয়টার্সকে বলেন, ‘সিরিয়ার অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিচ্ছে ইসরাইল। এটা অবশ্যই সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চুপ থাকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের কারণে তারা এই সুযোগ নিচ্ছে।’
বাকিল আরও বলেন, ‘নিজেদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে আরব ভূখণ্ড ব্যবহার করে ইসরাইল যেভাবে কথিত নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলছে, তাতে আরব রাষ্ট্রগুলো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।’
হামলা বন্ধ ও সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান
সিরিয়ায় ইসরাইলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া, তুরস্ক, মিসর, কাতার, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ। দেশগুলো বলছে, আসাদের পতনের পর ইসরাইলের এমন হামলা দেশটিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। ইসরাইলকে সিরিয়ায় হামলা বন্ধ ও দেশটির ভূখণ্ডে সেনা না পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে দেশগুলো।
সিরিয়ার সামরিক স্থাপনায় সর্বাত্মক হামলা ও দেশটির আরও ভূখণ্ড দখলে নেয়ার নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া। মস্কো বলেছে, ইসরাইলের এ ধরনের তৎপরতা ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় করা চুক্তির লঙ্ঘন। একই সঙ্গে ইসরাইলের এ ধরনের হামলা গভীর উদ্বেগের।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, ‘সিরিয়ার মানুষের স্বাধীনতা ও দেশটির সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এবং নতুন প্রশাসনকে অস্থিতিশীল করতে হামলা হলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা এর জবাব দেব।’
সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বুধবার জানান, বুধবার থেকে শুক্রবার তিন দিনের সফরে জর্ডান ও তুরস্কে যাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন।
আরও পড়ুন: নতুন সিরিয়া গড়তে সরকারের অর্থ প্রয়োজন: অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী
ইসরাইলের হামলা ও ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়াসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সিরিয়ায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নেতৃত্বে থাকা হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন কাতারের কূটনীতিকেরা। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এইচটিএস নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
সিরিয়ায় শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়া যাতে কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত না হয়, এ জন্য ইসরাইল ও তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জার্মানি। বুধবার জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্নালেনা বায়েরবক বার্লিনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সিরিয়ায় অভ্যন্তরীণ আলোচনার প্রক্রিয়া কেউ বাইরে থেকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইলে আমরা মেনে নেব না।’
গোলান মালভূমি থেকে সেনা প্রত্যাহারে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ফ্রান্সও। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, সেখানে সেনা পাঠানো আরব-ইসরাইল যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছেন, তেহরানের কাছে ‘প্রমাণ’ রয়েছে যে, সিরিয়ায় যা ঘটেছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইহুদিবাদী শাসকদের (ইসরাইল) যৌথ ষড়যন্ত্রের ফসল।
আসাদের পতনের পর বুধবার নিজের প্রথম মন্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘সিরিয়ার দখল হওয়া ভূখণ্ড মুক্ত করা হবে।’ ইরান ও দেশটির মিত্রদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে উৎখাত করবে প্রতিরোধের অক্ষশক্তি।’
শান্তির ডাক অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর
সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-বশির বলেছেন, এখন দেশটিতে শান্তি-স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সময়। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর বুধবার আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আল বশির এ কথা বলেন।
বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) প্রধান আবু মোহাম্মদ আল জোলানি বলেছেন, সিরিয়াকে পুনর্গঠন করা হবে। সিরিয়া উন্নয়ন ও পুনর্নির্মাণের পথে অগ্রসর হবে। সিরিয়া স্থিতিশীলতার পথে এগোবে। যুদ্ধের কারণে মানুষ ক্লান্ত। এই দেশ আরেকটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়। তারা আরেকটি যুদ্ধে জড়াতে যাচ্ছেন না।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা ও রয়টার্স