কোন প্রাণীটিকে আসলে সান্ডা বলে?
প্রকৃতপক্ষে সান্ডা বলতে সাধারণত Monitor Lizard বা Varanus bengalensis – এই প্রজাতিকে বোঝায়, যাকে বাংলায় আমরা ‘গুইসাপ’ বলি।
কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু এলাকার মানুষ ইউরোমাস্টিকস (Uromastyx) প্রজাতির টিকটিকিকে ভুলভাবে ‘সান্ডা’ নামে চেনে। বিশেষ করে যারা এগুলোকে তেল বা ঔষধি গুণে ব্যবহার করতে চান তারা সান্ডা নাম ব্যবহার করে থাকেন। অর্থাৎ গুইসাপের বদলে ইউরোমাস্টিকসই বাংলাদেশে সান্ডা নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
ইউরোমাস্টিকস তথা সান্ডার বৈশিষ্ট্য:
এগুলো এক প্রজাতির তৃণভোজী গিরগিটি (agamas); যাদের আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার মরু ও শুষ্ক অঞ্চলে পাওয়া যায়।
চেহারা ও গঠন: শরীর মোটা, মাথা ফ্ল্যাট, পা শক্তিশালী।
সবচেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য: কাঁটাযুক্ত মোটা লেজ। লেজ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় হুমকির সময়।
দৈর্ঘ্য: প্রজাতিভেদে দৈর্ঘ্য হতে পারে ২৫ থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত।
রং: বালুকাময় অঞ্চলে বসবাসকারী প্রজাতিগুলো সাধারণত ধূসর, বাদামি বা পীতাভ রঙের হয়। কিছু প্রজাতি রোদে গা গরম করার সময় চমৎকার রঙ ধারণ করতে পারে – যেমন কমলা, হলুদ বা সবুজ।
খাদ্যাভ্যাস: এরা সাধারণত তৃণভোজী হয়ে থাকে। মূলত গাছের পাতা, ফুল, শুষ্ক ঘাস, বীজ ইত্যাদি খায়। মাঝে মাঝে কীটপতঙ্গও খেতে দেখা যায়, বিশেষ করে ছোট বয়সে।
স্বভাব: দিনচর। দিনে সক্রিয় থাকে, রাতে ঘুমায়। খুব বেশি ছুটে বেড়ায় না। সূর্যস্নান করে শরীর গরম রাখে।
বাসস্থান: মরুভূমি বা শুষ্ক পাথুরে পরিবেশে বাস করে। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বাস করে।
প্রজনন: এরা ডিম পাড়ে। একটি স্ত্রী ইউরোমাস্টিকস ৬ থেকে ৩০টি ডিম দিতে পারে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সাধারণত ৬ থেকে ১০ সপ্তাহ সময় লাগে।
আত্মরক্ষা কৌশল: হুমকির মুখে পড়লে লেজ নেড়ে আঘাত করে। গর্তে ঢুকে পড়ে এবং লেজ দিয়ে গর্তের মুখ আটকে দেয়। এদের কিছু কিছু প্রজাতি রঙ পরিবর্তন করে আশপাশের পরিবেশে মিশে যেতে পারে।
আরও পড়ুন: সান্ডার বিরিয়ানি আর মাংস নিয়ে কেন এত হইচই?
মানুষের সঙ্গে সান্ডা তথা ইউরোমাস্টিকস এর সম্পর্ক:
অনেক দেশে পোষা প্রাণী হিসেবে জনপ্রিয়। কারণ এটি তুলনামূলক নিরীহ এবং এদের পরিচর্যা করাও সহজ। সাধারণত আক্রমণাত্মক নয়।
ইউরোমাস্টিকস (Uromastyx) সাধারণত খাওয়ার জন্য পালন করা হয় না, তবে কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে লোকজ বিশ্বাস, ভেষজ চিকিৎসা, অথবা সাংস্কৃতিক অভ্যাস থেকে মানুষ ইউরোমাস্টিকস খায় বা এর তেল ব্যবহার করে থাকে।
ইউরোমাস্টিকস কি খাওয়া হয়?
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় কিছু বেদুইন জনগোষ্ঠী ইউরোমাস্টিকস খায়। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কিছু এলাকায় লোকবিশ্বাস অনুযায়ী এদের তেল কামশক্তি বাড়ায় বলে মনে করা হয়, যদিও এটার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
ইউরোমাস্টিকস তথা সান্ডার তেল ও এর ব্যবহার:
প্রচলিত লোকবিশ্বাস অনুসারে অনেক সময় এদের চর্বি গলিয়ে “সান্ডা তেল” বানিয়ে তা কামশক্তি বৃদ্ধির ঔষধ হিসেবে বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্যানভাসাররা মিথ্যা এবং আকর্ষণীয় কথার ফাঁদে ফেলে এই “সান্ডা তেল” বিক্রি করেন। নিরক্ষর মানুষদের অনেকে তা কেনেনও।
সাধারণত “সান্ডা তেল” বলা হলেও, এটি গুইসাপ থেকে তৈরি বলে দাবি করা হয়, কিন্তু প্রায়ই ইউরোমাস্টিকসকেও এই কাজে মেরে ফেলা হয়।
ইউরোমাস্টিকস বা গুইসাপের তেলে কোনো প্রমাণিত ঔষধি গুণ নেই। এ ধরনের পণ্য বিক্রি সাধারণত প্রতারণা ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন।
ভারত পাকিস্তানসহ অনেক দেশে ইউরোমাস্টিকস সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত। এদের কিছু প্রজাতি বিপন্ন হিসেবে বিবেচিত। এগুলো খাওয়া বা তেল তৈরি করা শুধু অনৈতিকই নয়, বরং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী অপরাধ।
সান্ডা খেলে বা এর তেল ব্যবহারে কোনো প্রমাণিত উপকারিতা তো নেইই বরং তেল প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের সময় ব্যাকটেরিয়া বা বিষাক্ত উপাদান তৈরি হতে পারে; যা স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
অর্থাৎ সান্ডা নিধন যেমন অনৈতিক এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তেমনি এর তেলের ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
আরও পড়ুন: উড়ন্ত বিমানের দিকে ফুটবলে শট, ভাইরাল ভিডিও নিয়ে যা জানা গেল
সান্ডা খাওয়া কি জায়েজ?
ইউরোমাস্টিকস খাওয়া জায়েজ কি না—এই প্রশ্নের উত্তর ইসলামিক ফিকহের বিভিন্ন মাজহাব অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে।
ইউরোমাস্টিকসকে আরবিতে বলা হয় দাব্ব "الضبّ"।
হাদিসে যাকে দাব্ব বলা হয়েছে, অধিকাংশ আলেমের মতে সেটা Uromastyx aegyptia অর্থাৎ ইউরোমাস্টিকসই অর্থাৎ বাংলাদেশে যে গুইসাপ পাওয়া যায় সেটি নয়।
এক্ষেত্রে সহিহ বুখারীর ৫৩৯১ নম্বর হাদিসটি উল্লেখযোগ্য-
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ) যাকে ‘সাইফুল্লাহ্’ বলা হতো তার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে মাইমূনাহ (রাঃ)-এর গৃহে প্রবেশ করলেন। মাইমূনাহ (তার ও ইবনু ‘আব্বাসের খালা ছিলেন। তিনি তার কাছে একটি ভুনা দাব্ব দেখতে পেলেন, যা নজদ থেকে তার (মাইমূনাহর) বোন হুফাইদা বিন্ত হারিস নিয়ে এসেছিলেন। মাইমূনাহ (রাঃ) দাব্বটি রাসূলুল্লাহ স.-এর সামনে হাজির করলেন। রাসুলের অভ্যাস ছিল, কোনো খাদ্যের নাম ও তার বর্ণনা বলে না দেয়া পর্যন্ত তিনি খুব কমই তার প্রতি হাত বাড়াতেন।
তিনি দাব্বের দিকে হাত বাড়ালে উপস্থিত মহিলাদের মধ্যে একজন বললেন, তোমরা রাসূলুল্লাহ স.-এর সামনে যা পেশ করছ সে সম্বন্ধে তাকে অবহিত কর। বলা হল- হে আল্লাহর রাসূল! ওটা দাব্ব। এ কথা শুনে রাসূল স. তার হাত উঠিয়ে নিলেন। খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! দাব্ব খাওয়া কি হারাম? তিনি বললেন, না। কিন্তু যেহেতু এটি আমাদের এলাকায় নেই। তাই এটি খাওয়া আমি পছন্দ করি না। খালিদ (রাঃ) বলেন, আমি সেটি টেনে নিয়ে খেতে থাকলাম। আর রাসূল স. আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। [৫৪০০, ৫৫৩৭; মুসলিম ৩৪/৭, হাঃ ১৯৪৫, ১৭৪৬, আহমাদ ১৬৮১৫] (আধুনিক প্রকাশনী- ৪৯৯০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৮৮৬)
এই হাদিস থেকে বুঝা যায়, নবী সা. নিজে দাব্ব খাননি, কিন্তু সাহাবিগণকে খেতে নিষেধও করেননি। ফলে এটা স্পষ্ট যে, এটা হারাম নয়।
অধিকাংশ মাজহাব মতে দাব্ব খাওয়া জায়েজ। হানাফি মাজহাবে এটি খাওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
ইসলামিক শরিয়তে কোনো প্রাণীকে কষ্ট দিয়ে মারা বা অপ্রয়োজনে হত্যা করা হারাম। ইউরোমাস্টিকস অনেক দেশে সংরক্ষিত প্রাণী, সুতরাং আইন ভাঙাও ইসলামিকভাবে অন্যায়।
আজকাল যেসব "সান্ডা তেল" বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলোর অধিকাংশই ভুয়া এবং প্রাণী হত্যার মাধ্যমে আসে — যা স্পষ্ট প্রতারণা।
অর্থাৎ নৈতিকতা, পরিবেশ ও আইনগত দিক বিবেচনায় ইউরোমাস্টিকস খাওয়া এড়িয়ে চলা উত্তম।