সহিংস ও বিভাজন সৃষ্টিকারী হয়ে উঠেছে ধর্মীয় অপতথ্য: ডিসমিসল্যাব

৪ সপ্তাহ আগে
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাবে ধর্মীয় অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। পরিবর্তন এসেছে অপতথ্যের ধরনেও। তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটা দাবি করা হয়েছে।

ধর্মীয় অপতথ্য ছড়ানোর চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে যেখানে অলৌকিকতা, ধর্মান্তর বা ধর্মীয় মহিমা প্রচার সংক্রান্ত বিভিন্ন ভুল দাবি বেশি দেখা গেছে, সেখানে আগস্টের পর থেকে ক্রমে বেড়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘাতমূলক বা ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য।

 

এই সময়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সংশ্লিষ্ট ভুল তথ্যের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ এবং বছরের প্রথম সাত মাসের তুলনায় ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য বেড়েছে দ্বিগুণ, বলছে প্রতিবেদন।

 

প্রতিবেদন মতে, শুধু বিষয়বস্তুর ধরনে নয়, পরিবর্তন দেখা গেছে ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায়ও। আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ধর্ম বিষয়ে ফ্যাক্টচেক হওয়া ভুল তথ্যের ৯২ শতাংশ ছিল বাংলাদেশ-কেন্দ্রিক, যেখানে বছরের প্রথম তিন মাসে আন্তর্জাতিক বা স্থান নিরপেক্ষ ধর্মীয় অপতথ্যের পরিমাণই বেশি দেখা গিয়েছিল।

 

ডিসমিসল্যাব বলছে, কীভাবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় ভুল তথ্যের ধরন বদলেছে, তা এই পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট। আর এসব অপতথ্য সামাজিক বিভাজন তৈরি করছে এবং বিরোধ উসকে দিচ্ছে।

 

আরও পড়ুন: সাংবাদিকতায় দ্রুতগতি আসায় অনেক অপতথ্য ছড়ায়: আসিফ নজরুল

 

তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট আটটি ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ধর্ম বিষয়ক ভুল তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র দেখা গেছে।

 

প্রতিবেদন মতে, এই সময়ে আটটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা ধর্ম বিষয়ে ৩১৩টি স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। একই বিষয়ে একাধিক সাইটে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে একটিকে শুধু বিবেচনা করা হয়েছে স্বতন্ত্র হিসেবে। দেখা যায়, এই ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলোর ৫১ শতাংশই প্রকাশিত হয়েছে শেষ চার মাসে, আগস্ট থেকে নভেম্বরে।

 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ে ধর্মীয় ভুল তথ্যের ধরনে দুইটি প্রধান বিষয় লক্ষ্য করা গেছে: এক. বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয়েছে উগ্র ইসলামপন্থী রাষ্ট্র হিসেবে, যেখানে সংখ্যালঘুরা অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। 

 

এই ধরনের ভাষ্য প্রচারিত হয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের দিক থেকে। দুই. এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায় ও সংগঠনের বিরুদ্ধে, যা নভেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে।

 

ধর্মীয় অপতথ্যের ধরনে পরিবর্তন

 

বাংলাদেশে যেসব ভুল তথ্য ছড়াতে দেখা যায়- তার একটি অন্যতম বিষয় ধর্ম। ডিসমিসল্যাব জানিয়েছে, তাদের চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের প্রবণতা বিশ্লেষণে ধর্মীয় ভুল তথ্যের পরিমাণ বাড়তে দেখা গিয়েছিল। তবে ১১ মাসের ডেটা বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, ধর্ম বিষয়ে ৩১৩টি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের ৫১ শতাংশই প্রকাশিত হয়েছে গত চার মাসে। আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে।

 

ডিসমিসল্যাব জানিয়েছে, ধর্মীয় অপতথ্যের ভাষ্যে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে– তা বিশ্লেষণের জন্য ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলোকে ৯টি বিভাগে ভাগ করেছে তারা। অলৌকিকতা, ধর্মীয় মহিমা প্রচার, ধর্মান্তর, ধর্মীয় বিধান, ধর্মীয় সম্প্রীতি, ধর্ম অবজ্ঞা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও অন্যান্য। এবং এসব অপতথ্যকে ভাগ করা হয়েছে দুইটি সময়পর্বে: প্রাক-গণঅভ্যুত্থানের সময় (জানুয়ারি-জুলাই) এবং গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় (আগস্ট-নভেম্বর)।

 

তাতে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে যেসব ধর্মীয় অপতথ্য ছড়িয়েছে তার অর্ধেকই ছিল ধর্মীয় মহিমা প্রচার (৩৩ শতাংশ), ধর্মান্তর (৯ শতাংশ), অলৌকিকতা (৬ শতাংশ), সংক্রান্ত বিষয়। 

 

যেমন, কাবা শরীফের ছাদে ফেরেশতা দেখা গেছে, আকাশে আল্লাহর নাম ভেসে উঠেছে, বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি হিন্দু বা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন ইত্যাদি। ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত সংক্রান্ত অপতথ্যের পরিমাণ ছিল ১০ শতাংশের কম।

 

আরও পড়ুন: 'গুজব ও অপতথ্য রোধে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে'

 

কিন্তু আগস্টে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধর্মীয় অপতথ্যের ধরন বদলেছে। দেখা গেছে, ধর্মীয় মহিমা, ধর্মান্তর বা অলৌকিকতা বিষয়ক ভুল তথ্য নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের পরিমাণ কমেছে। এবং সেই জায়গা দখল করেছে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য।

 

প্রতিবেদন মতে, এই সময়পর্বে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ ও ২১ শতাংশে। সহজ ভাষায়, এ বছরের প্রথম সাত মাসের তুলনায় শেষ চার মাসে সাম্প্রদায়িক সংঘাতমূলক অপতথ্যের পরিমাণ বেড়েছে পাঁচগুন। এবং ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্যের পরিমাণ বেড়েছে দুইগুণ।

 

যেভাবে ক্রমেই সহিংস হয়েছে ধর্মীয় অপতথ্যের ভাষ্য

 

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন মতে, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় ভুল তথ্যের ধরনে দুইটি প্রধান বিষয় লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয়েছে উগ্র ইসলামপন্থী রাষ্ট্র হিসেবে, যেখানে সংখ্যালঘুরা অনিরাপদ হয়ে পড়েছে।

 

এই ধরনের ভাষ্য প্রধানত প্রচারিত হয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের দিক থেকে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া পেজ-প্রোফাইল থেকে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায় ও সংগঠনের বিরুদ্ধে। এই দুই ধরনের ভাষ্য একসঙ্গে মিলে সামাজিক বিভাজন ও উত্তেজনা বাড়িয়েছে।

 

আগস্টে ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের দিক থেকে এমন অনেক ভুয়া দাবি করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন বেড়েছে, ইসলামী চরমপন্থার উত্থান হয়েছে।

 

কোথাও এমন দাবি করা হয়েছে পুরোনো বা অপ্রাসঙ্গিক ছবি-ভিডিও দিয়ে, কোথাও মুসলিম ব্যক্তি বা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার দৃশ্যকে উপস্থাপন করা হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হিসেবে। কোথাও আবার দাবি করা হয়েছে, তিন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে ২৭ হাজার হিন্দু নিহত হয়েছে।

 

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে ফতোয়া জারির গুজব নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে নিউজ

 

প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা রিউমর স্ক্যানার ৫-১৩ আগস্ট পর্যন্ত ছড়ানো এ ধরনের অপতথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছিল, যে ৫০টি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে এসব অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে, তাদের ৭২ শতাংশই থাকেন ভারতে। 

 

এছাড়াও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়া তিন ছাত্রনেতা আগে নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্য ছিলেন– এমন মিথ্যা দাবিও উঠতে দেখা গেছে। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে ইসলামী মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।

 

আগস্ট থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের এসব মিথ্যা দাবি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য। কোথাও বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিন্দুদের দেশ ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন বা গণহত্যার আহ্বান জানিয়েছেন, কোথাও আবার দাবি করা হয়েছে যে, ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে মিছিল করে হিন্দুদের জবাই করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। 

 

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ না দিলে অপহরণের শিকার হতে হবে, বন্যার ত্রানের বিনিময়ে হিন্দু শিশুর গলা থেকে তাবিজ খুলে নেওয়া হচ্ছে– এ ধরনের অপতথ্য ছড়াতে দেখা গেছে।

 

অক্টোবরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব দুর্গাপূজা কেন্দ্র করে আরও বেড়েছে এ ধরনের ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য। কোথাও দাবি করা হয়েছে পূজামণ্ডপে ইসলামি বাণী প্রচার করা হচ্ছে বা মোনাজাত করা হচ্ছে, আবার কোথাও বলা হয়েছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা পূজামণ্ডপে গিয়ে গোলমাল করেছেন।

 

নভেম্বরে এ ধরনের অপতথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে চট্টগ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন, ইসকন-বিরোধী একটি ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ এবং  ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’ নামের নতুন একটি সংগঠনের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার সংক্রান্ত ঘটনাবলি।

 

আরও পড়ুন: শুধু ভারত নয়, চীন ও রাশিয়া থেকেও গুজব ছড়াচ্ছে: শফিকুল আলম

 

গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে ইসকন-বিরোধী ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষে সেনাবাহিনীর ৫ সদস্যসহ পুলিশের ১২ সদস্য আহত হন। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার করা হয় ফেসবুক পোস্ট দেয়া সেই ব্যক্তি এবং সংঘর্ষে জড়িত ৪৯ জনকে।

 

২৬ নভেম্বর একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’-এর মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে। চট্টগ্রামের আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুর করা হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় তার অনুসারীরা।

 

এসময় এই ঘটনা ঘিরে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক নানা অপতথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিভিন্ন ভুয়া উদ্ধৃতি প্রচারিত হয়েছে গণমাধ্যমের ফটোকার্ড নকল করে। তিনি আগে ইসকনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ইসকনকে নিয়েও ছড়িয়েছে কিছু ভুয়া তথ্য।

 

যেমন কোথাও বলা হয়েছে, সিলেটের ইসকন মন্দির থেকে অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, বা বাংলাদেশের একটি সুপারশপ ও একটি অন্যতম আন্তঃজেলা পরিবহন সংস্থা,শ্যামলী পরিবহন ইসকনকে অর্থপ্রদান করেছে। 

 

আরও পড়ুন: ইসকন নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া গুজব ছড়াচ্ছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যম ইসকনকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ইসকনকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে– এমন ভুয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তিও প্রচারিত হতে দেখা গেছে।

 

বিপরীতে কিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচারিত ভুল তথ্য এ ঘটনাগুলো নিয়ে আরও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। যেমন, ভুলভাবে দাবি করা হয়েছে যে, চিন্ময় দাসের আইনজীবীকে হত্যা করা হয়েছে।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন