সমুদ্রে গেলেই অনিশ্চয়তা, ট্রলারডুবিতে প্রতি বছরই নিখোঁজ হচ্ছেন জেলেরা

৫ দিন আগে
বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে গিয়ে প্রতিবছরই ডুবে যাচ্ছে অসংখ্য ট্রলার, হারিয়ে যাচ্ছেন শত শত জেলে। কারও লাশ ভেসে আসে, আবার অনেকের কোনো খোঁজও মেলে না। এতে কর্মক্ষম স্বজন হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছে পরিবারগুলো। কারও সংসার চলছে ধার-কর্জে, কেউবা প্রতিবেশীর সাহায্যে। অথচ সমুদ্রে নিখোঁজ জেলেদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যানই নেই সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে।

৬২ বছর বয়সী নজরুল ইসলাম ছিলেন পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়ার একজন অভিজ্ঞ জেলে। দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রে মাছ শিকার করতেন তিনি। গত ২৫ জুলাই রাতে গভীর সমুদ্রে ঝড়ে পড়ে ডুবে যায় তার ট্রলার। নিখোঁজ হন ১৫ জন জেলে। এক সপ্তাহ পর গত ১ আগস্ট কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে ওঠে নজরুলের নিথর দেহ।

 

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে এখন দিশেহারা তার স্ত্রী ও সন্তানরা। নজরুলের স্ত্রী বলেন, ‘আমাদের তো আর কেউ রইল না। সংসার চলে প্রতিবেশীর দেয়া চাল-ডালে। মালিক কোনো টাকা দেয়নি, সরকার থেকেও এখনো কিছু পাইনি। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকালে বুকটা ফেটে যায়।’

 

আরও পড়ুন: ভরা মৌসুমেও চড়া ইলিশের বাজার, কবে নাগাদ দাম কমতে পারে?

 

শুধু নজরুলের পরিবার নয়, পটুয়াখালী, ভোলা ও বরগুনার উপকূলে এমন হাজারো পরিবারের আর্তনাদ শোনা যায়। প্রতি বছরই সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্ঝায় প্রাণ হারান অসংখ্য জেলে। কেউ কেউ বছরের পর বছর নিখোঁজ থাকেন, যাদের লাশও আর ঘরে ফেরে না। শুধু ট্রলার ডুবিই নয়, দিকভ্রান্ত হয়ে ভারতীয় জলসীমায় ঢুকে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাও ঘটে। রেখে যান শোক, অনিশ্চয়তা আর দারিদ্র্যের তীব্র বোঝা।

 

সমুদ্রগামী জেলে কালাম মাঝি বলেন, ‘পেটের দায়ে তো সমুদ্রে নামতেই হয়। জানি ঝুঁকি আছে। ঢেউ উঠলে ভয় লাগে, কিন্তু ঘরে খাবার না থাকলে ভয় ভুলে যাই। অনেকে আর ফেরত আসে না, তখন তাদের পরিবার না খেয়ে থাকে।’

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক জেলে জোড়াতালির ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে গভীর সমুদ্রে যান। এসব নৌযানে নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল হক বলেন, ‘আমাদের জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে যান। অধিকাংশ ট্রলারেই যথেষ্ট লাইফ জ্যাকেট বা লাইফ বয়া থাকে না। দুর্ঘটনার সময় আত্মরক্ষার সুযোগ পান না তারা। তাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে জেলেদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে, নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে এবং আবহাওয়ার সতর্কতা ব্যবস্থা আরও কার্যকর করতে হবে।’

 

মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুর রউফ বলেন, ‘নিবন্ধিত জেলে সমুদ্রে দুর্ঘটনায় নিখোঁজ বা মৃত্যুবরণ করলে তাদের পরিবারকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়। তবে সঠিক তথ্য না মেলার কারণে অনেক পরিবারই এ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। এজন্য নিবন্ধন কার্যক্রম আরও জোরদার করা হচ্ছে।’

 

আরও পড়ুন: বৈরী আবহাওয়ায় বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবি, ৩ জেলে নিখোঁজ

 

তবে বাস্তবে দেখা যায়, অগণিত পরিবার কোনো সহায়তাই পায় না। নিবন্ধন অসম্পূর্ণ থাকা বা দুর্ঘটনার প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। স্থানীয় জেলে সংগঠনের নেতারা বলছেন, সরকার ও ট্রলার মালিকপক্ষের সমন্বিত সহায়তার অভাবে পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়ে। জেলে নেতা নাসির মৃধা বলেন, ‘প্রতিটি ট্রলারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম থাকতে হবে। আর কোনো পরিবারকে যেন স্বজন হারিয়ে অনাহারে দিন কাটাতে না হয়, সে জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন জরুরি।’

 

প্রতি বছর হাজারো জেলে সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু এখনো কার্যকর উদ্ধার অভিযান, রেসকিউ সেন্টার কিংবা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বছরের পর বছর বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছেন জেলেরা। কিন্তু অনেকেই আর ঘরে ফেরেন না। উপকূলে ফিরে আসে শুধু অপেক্ষা, শোক আর হাহাকার।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন