লবণের দাম নেমেছে কেজিতে ৪ টাকায়, ফের আন্দোলনে নামছেন চাষিরা

৩ সপ্তাহ আগে
উপকূলে বেড়েছে লবণ চাষের জমির পরিমাণ, বেড়েছে চাষিও। যার কারণে চলতি মৌসুমের একমাস বাকি থাকলেও এরই মধ্যে লবণ উৎপাদন ছাড়িয়েছে ১৮ লাখ মেট্রিক টনে। কিন্তু লবণের মূল্য নিয়ে চরম হতাশ চাষিরা। তাদের দাবি, এখন মাঠ পর্যায়ে প্রতিমণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। এতে প্রতি মণের বিপরীতে চাষিদের লোকসান হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। এ অবস্থায় ফের আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের।

চলতি মৌসুমে ৬৯ হাজার ১৯৮ একর জমিতে লবণ চাষ করছেন ৪১ হাজার ৩৫৫ চাষি। আর দেশে লবণের চাহিদা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) পর্যন্ত ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছে।


প্রতিদিন গড়ে মাঠে লবণ উৎপাদন হচ্ছে ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। মাঠ পর্যায়ে যতই লবণ উৎপাদন বাড়ছে ততই কমছে লবণের দাম। চাষিরা বলছেন, প্রতিমণ লবণ উৎপাদনের বিপরীতে খরচ হয় ৪০০ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু দফায় দফায় লবণের দাম কমে যাওয়ার কারণে দুশ্চিন্তায় চাষিরা। মৌসুমের শুরুতে প্রতিমণ লবণ ২৮০ থেকে ২৬০ টাকা বিক্রি হলে তা এখন নেমে এসেছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। সিন্ডিকেট করেই দাম কমিয়ে দেয়া হচ্ছে অভিযোগ তাদের। একই সঙ্গে দুষছেন বিসিককেও।


বাঁশখালীর লবণচাষি রফিক বলেন, 'করুণ অবস্থা, লবণের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি না। কারণ ৪৭ কেজি লবণ বিক্রয় করে আমরা ২৫০ গ্রাম মাছ কিংবা ২৫০ গ্রাম মাংস কিনতে পারছি না। এমন অবস্থা এখন লবণচাষিদের।'


চকরিয়ার লবণচাষি নুরুল আজিম বলেন, 'লবণ কোম্পানিগুলো ১ কেজি লবণে ১২ টাকা খরচ করে তারা ৪৮ টাকা বিক্রি করে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো এক কেজি লবণে প্রায় ৩৬ টাকা লাভ করছে। আর আমাদের ১ কেজি লবণ উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১০ টাকার বেশি, কিন্তু এখন মাঠ পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪ টাকায়। আমরা কী দোষ করেছি।'


টেকনাফের লবণচাষি হুয়ামুন কবির বলেন, 'টেকনাফের লবণ চাষিদের মুখে হাসি নেই। কারণ, ৩০ থেকে ৩৫ হাজার লবণের মাঠ নিয়ে এখন এক মণ লবণে যাতায়াত খরচসহ মিলে পাচ্ছি শুধুমাত্র ১২০ টাকা। যেখানে এক মণে খরচ হচ্ছে ৪০০ টাকা। এ অবস্থায় অনেক চাষি লবণ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।'


মহেশখালীর লবণচাষি শুভ বলেন, 'আমরা বারবার মুক্তবাজার অর্থনীতির একটা রেফারেন্স পায়। যে কারণে কোনোভাবে লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করছে না। ন্যায্যমূল্য নির্ধারণের জন্য যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেটা হচ্ছে বিসিক। কিন্তু বারবার বিসিকের যে ভূমিকা সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ চাষিদের কল্যাণে আসলে বিসিক কি করছে সেটা আমরা এখনো বুঝতে পারছি না।'


আরও পড়ুন: সংকটে লবণ শিল্প, ৩২ কারখানার মধ্যে চালু একটি


লবণ চাষি শহিদুল ইসলাম বলেন, 'নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে লবণের দামটাই শুধু দরপতন হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, লবণের দাম দরপতন হওয়ার পরে, আমরা কি লবণ কম দামে কিনতে পারছি? ইন্ডাস্ট্রি থেকে যে লবণ বের হচ্ছে, ওরা তো ৪০ থেকে ৫০ টাকা করে লবণ কিনতে হচ্ছে আমাদের। তাহলে ৪ টাকা করে যদি লবণ দরপতন হয়, সে অনুপাতে প্যাকেট লবণের দাম কমলো না কেন।'


তিনি আরও বলেন, 'মিল মালিকরা শুভঙ্কর ফাঁকি দিয়ে মূলত চাষিদেরকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বাংলাদেশ থেকে যেন লবণ শিল্পটা উঠে যাই এই চেষ্টা করছে। যাতে লবণ আমদানি নির্ভরশীল হয়ে যাই মিলের মালিকরা সিন্ডিকেট করে এই ঘটনা ঘটাচ্ছে।'


এরই মধ্যে আরেক দফা লবণ দাম কমায় গত বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) জরুরি মতবিনিময় সভা করেন কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার লবণচাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। তাদের দাবি, সিন্ডিকেট করে লবণ শিল্পকে ধ্বংস করছে মাফিয়া চক্র। এই চক্রকে ভাঙ্গতে পারবে একমাত্র সরকার। আর লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের জন্য আরেক দফা আন্দোলনে যাবার ঘোষণা তাদের।


কক্সবাজার লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী খোকন মিয়া বলেন, 'লবণচাষিদের দাবিগুলো কেন জানি পূরণ হচ্ছে না। দিন দিন লবণের বাজার নিম্নমুখী। এটার জন্য দায়ী মাফিয়া সিন্ডিকেট লবণ মিল মালিকরা। ৪ টাকায় কিনে ৫০ টাকায় বিক্রি করছে। এই সিন্ডিকেটকে ভাঙা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গার জন্য সরকারই পারে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে। কারণ এরকম কোনো ব্যবসা নেই পৃথিবীতে ৪ টাকায় কিনে ৫০ টাকা বিক্রি করা। এতো মুনাফা কোথাও নেই। আমরা আশা করব, আমরা আন্দোলনে আছি আন্দোলনে থাকব। আমরা গতবার খুটাখালিতে লবণ ফেলেছি। বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে আমরা কর্মসূচি দিয়েছি যে চাষিদের সঙ্গে মতবিনিময় করব। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চাইব। যদি উনাকে বুঝাতে পারি তবে কাজটা দ্রুত হবে, নাহলে আমরা আন্দোলনেই থাকব।'


আরও পড়ুন: কাফনের কাপড় পরে মহাসড়ক অবরোধ করে লবণ চাষিদের বিক্ষোভ


কক্সবাজার লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জামিল ইব্রাহীম বলেন, 'বিসিক তথ্য দেওয়ার সময় বারবার চাষিদের স্বার্থ দেখে না। দেখে কিছু ফড়িয়া এবং শিল্প মালিক যারা বহুজাতিক কোম্পানির সাথে জড়িত। বিসিক বারবারই তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। আমরা অতীতেও দেখেছি বিসিক কখনও এই লবণ চাষিদের সেবাই এগিয়ে আসেনি। তথ্য বিভ্রাট করে ঘাটতি না থাকলেও ঘাটতি দেখিয়ে এভাবে লবণ আমদানি করার জন্য তারা কিছু কুচক্রী মহলের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে পাঁয়তারা চালায় লবণ মৌসুমে। চাষিদের স্বাস্থ্য ও স্বার্থ এগুলো সরকারকে দেখতে হবে।'


এদিকে বিসিক বলছে, লবণের সরবরাহ বাড়ার কারণে দাম কমেছে। তবে চাষিদের একসঙ্গে সব লবণ বিক্রি না করে ধাপে ধাপে বিক্রি পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।


কক্সবাজার লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয় (বিসিক) এর উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, 'এটা মুক্তবাজার অর্থনীতি, এখানে দাম বেধে দেওয়ার আসলে সুযোগ নেই। এখানে বাজারে যেহেতু সরবরাহ বেশি দেখা যাচ্ছে এজন্য দামটা কমে গেছে। কারণ আমাদের যেটা মজুদ লবণ এটাতো এখন নতুন লবণ রাখার জন্য চাষিরা গর্ত থেকে বের ফেলছে। একইসাথে নতুন লবণও উঠছে যার কারণে সরবরাহটা বেশি আছে। এর ফলে বাজারে মূল্যটা একটু কম। আমরা চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছি সব লবণ একসাথে বিক্রয় না করে ধাপে ধাপে বিক্রয় করার জন্য। যাতে করে বাজারে সরবরাহের ঘাটতিও না হয় আবার একেবারে অতিরিক্ত সরবরাহও না হয়। তাহলে দামটা একটু উর্ধ্বমুখী অবস্থায় যাবে।'

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন