পাউবোর তথ্যমতে, দুধকুমার নদে ৬৯২ কোটি টাকা, ধরলায় ৬২৯ কোটি টাকা, এবং ব্রহ্মপুত্রে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বর্তমানে চলমান। তিস্তা নদীতে ভাঙন প্রতিরোধে নেওয়া হয়েছে ২০০ কোটি টাকার জিও ব্যাগ ডাম্পিং প্রকল্প। তবে প্রকল্পের আওতায় না আসা ৬৫০ কিলোমিটার নদীতীরে এখনও কোনো স্থায়ী বাঁধ নেই। সাময়িক সংস্কার এবং জরুরি ভিত্তিতে মেরামতই এখনো নদীভাঙন রোধের মূল ভরসা।
২০২৪ সালে জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার কাজে ব্যয় করা হয় মাত্র ১৪ কোটি টাকা, আর ২০২৫ সালের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ২০ কোটি টাকা। বিশাল ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা এবং ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনায় এই বরাদ্দ অপ্রতুল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, শুধু তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে প্রতিবছর প্লাবন ও ভাঙনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। তীব্র স্রোত ও বাঁধহীন নদীতীরবর্তী এলাকায় প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি, ফসলি জমি ও অবকাঠামো।
গাইবান্ধার করতোয়া ও তিস্তার ২১ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অন্তত ২০টি পয়েন্টে ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কুড়িগ্রামের রৌমারী, চিলমারী, উলিপুর, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ এবং লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জসহ নদীপাড়ের হাজার হাজার মানুষ বছরের পর বছর ধরে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন।
রফিকুল ইসলাম নামে ফুলছড়ির এক কৃষক বলেন, সারা বছর চাষ করে যা পাই, সবই নদীতে ভেসে যায়। গত তিন বছরে দুই বিঘা জমি তিস্তা গিলে নিয়েছে। আর জমি নেই, এখন ধার করে সংসার চালাই।
আরও পড়ুন: পদ্মার ভাঙনের কবলে বাড়িঘর, মহাসড়ক অবরোধ ভুক্তভোগীদের
হালিমা খাতুন নামে উলিপুরের এক গৃহবধূ বলেন, তিনবার ঘর বদলেছি ভাঙনের কারণে। আগে টিনের ঘর ছিল, এখন প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে কোনো রকমে বাচ্চাদের নিয়ে থাকি। সরকার কবে আমাদের জন্য কিছু করবে কে জানে!
আবুল হোসেন সুন্দরগঞ্জের এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, এই নদী এক সময় আমাদের জীবিকা ছিল, এখন ভয়। বাঁধের কথা শুনি, কাজ কিছু দেখি না। বয়স হয়েছে, কিন্তু এখনো মাথা গোঁজার জায়গার নিশ্চয়তা নেই।
‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, ‘বারবার ভাঙন প্রতিরোধের কথা শোনা গেলেও, মাঠে বাস্তবায়ন নেই। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এই দুর্যোগ রোধ সম্ভব নয়।’
‘রিভারাইন পিপল’-এর পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘নদী ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া এই বিশাল ক্ষতির লাগাম টানা যাবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড যে সব প্রকল্প গ্রহণ করেছে, তা জনবান্ধব না হওয়ায় শুধুই অর্থের অপচয় হচ্ছে।’
আরও পড়ুন: ভাঙনে দিশেহারা পদ্মাপাড়ের বাসিন্দারা, জিও ব্যাগ-টিউবেও মিলছে না স্বস্তি
পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানিয়েছেন, ‘চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে নদী ভাঙন অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে।’
কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণ, সুরক্ষা প্রকল্প এবং জরুরি ভিত্তিতে কাজ চলমান রয়েছে।’
তবে বাস্তবতা হলো, নদীর ক্ষতচিহ্ন দিন দিন বড় হচ্ছে, এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি ও প্রভাব এখনো নদীপারের মানুষদের জীবনে আশার আলো জাগাতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীভাঙন ঠেকাতে শুধু বাজেট নয়, প্রয়োজন সময়োপযোগী, দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত পরিকল্পনার প্রয়োজন।