প্রায় দেড় দশকের এ সংগ্রামের পর শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে সিরিয়ার মুক্তিকামী মানুষ। বিদ্রোহীরা উচ্ছেদ করতে সমর্থ হয়েছে দেশটির অর্ধশতাব্দীব্যাপী চলা একক পরিবারের স্বৈরশাসন। গত ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীদের অগ্রাভিযানের মুখে রাজধানী দামেস্কে নিজের সুরক্ষিত বিলাসবহুল প্রাসাদ ছেড়ে সপরিবারে রাশিয়ায় পালিয়ে যান স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদ। এর মাধ্যমে অবসান হয় তার দুই যুগের নিপীড়নমূলক শাসনের।
তবে বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার মানুষ নতুন করে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হলেও যুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটির অর্থনীতি। ধ্বংস হয়ে গেছে অবকাঠামো থেকে শুরু করে সব ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ, পরিবহন এবং স্বাস্থ্যসেবা খাত প্রায় পুরোপুরি ধসে পড়েছে।
রাক্কা ও আলেপ্পো শহরজুড়ে চোখে পড়ে বিধ্বস্ত ভবনের সারি। যুদ্ধের জেরে বন্ধ অধিকাংশ কলকারখানার চাকা। ফলে উৎপাদনসহ ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম একরকম স্থবির। এ পরিস্থিতিতে যুদ্ধের ক্ষত সারিয়ে সিরিয়ার অর্থনীতির হাল ফেরা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাশার আল-আসাদের পতনের পর উল্লসিত হলেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সাধারণ সিরীয়রাও।
আরও পড়ুন: আসাদের বাবার কবর জ্বালিয়ে দিলেন সিরিয়ার বিদ্রোহীরা
চৌদ্দ বছরের অব্যাহত সংঘাতে দেশ ছেড়েছে প্রায় ৫০ লাখ সিরীয় মানুষ, যা দেশটির সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগ। পাশাপাশি ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর দি কোঅর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্স বা ওসিএইচএর দেয়া তথ্যমতে, যুদ্ধের কবলে পড়ে দেশের মধ্যেই বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছেন আরও প্রায় ৭০ লাখ সিরীয়।
২০১১ সালে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল সিরিয়ায়, তখন দেশটির জিডিপি ছিল ৬৭.৫ বিলিয়ন ডলার। তবে ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধে দেশটির জিডিপি প্রায় ৮৫ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়ে বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯ বিলিয়ন ডলারে। এর মাধ্যমে বর্তমানে সিরিয়া পরিণত হয়েছে তেল ও অন্যান খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্রে।
পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়েছে দেশটির মুদ্রারও। এর জেরে সিরিয়ার সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে বিপুলভাবে। সিরিয়ান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর দেয়া তথ্যমতে বর্তমানে সিরিয়ার অর্ধেকেরও বেশি লোক অবস্থান করছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহেও হিমশিম খাচ্ছেন।
যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সিরিয়া ছিল মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধ দেশ। দেশটির অর্থনীতির প্রধান দুই ভিত্তি ছিল তেল সম্পদ ও কৃষি উৎপাদন। সিরীয় সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস ছিল তেল উত্তোলন। পাশাপাশি কৃষি ছিল জিডিপির মূল ভিত্তি। তবে প্রায় দেড় দশকের যুদ্ধে বর্তমানে তেল শিল্প ও কৃষি উৎপাদন দুই খাতই বিধ্বস্তপ্রায়। যুদ্ধের শুরুতেই বাশার আল-আসাদের সরকার নিয়ন্ত্রণ হারায় সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থিত তেল ক্ষেত্রগুলো থেকে।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, যুদ্ধের ক্ষতি সহসাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না সিরীয়বাসীর জন্য। সিরিয়ার পুনর্গঠনে লেগে যেতে পারে আরও প্রায় এক দশক। এক গবেষণায় দেখা গেছে সিরিয়ার জিডিপি ২০১১ সালের যুদ্ধ পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নিতেও সময় লাগবে আরও দশ বছর। পাশাপাশি বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ায় ঘনীভূত হওয়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেক বিশ্লেষকই।
আরও পড়ুন: অবিরাম হামলা চালিয়ে সিরিয়ার আত্মরক্ষার ক্ষমতা কেড়ে নিতে চায় ইসরাইল
সিরিয়ার অর্থনীতি পুনর্গঠনের পথে আরও একটি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব। কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার পুনর্গঠনে প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণ অর্থের। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়বে দেশটির জন্য।
২০১৯ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার পুনর্গঠনে তখনই প্রয়োজন ছিল প্রায় ৪শ বিলিয়ন ডলার। এর পরে যুদ্ধে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটি। ফলে সিরিয়া পুনর্গঠনের বর্তমান খরচ বেড়ে দাঁড়াবে অনেক বেশি। পাশাপাশি নিজ দেশের জনগণের ওপর নির্যাতন, গণহত্যা এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সাবেক শাসক বাশার আল-আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। বাশার আল-আসাদ বিদায় হলেও পশ্চিমা বিশ্ব এ নিষেধাজ্ঞা তুলবে কি না সে ব্যাপারেও রয়েছে অস্পষ্টতা।
আরও পড়ুন: সিরিয়ায় ‘নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল’ গড়ে তুলবে ইসরাইল!
এ পরিস্থিতিতে বাশার আল-আসাদ পরবর্তী সময়ে সিরিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বে যারা থাকবেন তাদের সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি দিতে হবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই। বাশার আল-আসাদের পতনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই তুরস্কসহ প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়া সিরীয় শরণার্থীরা দলে দলে দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি যুদ্ধের কারণে নিজের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বিভিন্ন আশ্রয় শিবির কিংবা দেশের ভেতরেই অন্যত্র আশ্রয় নেয়া সিরীয়রা নিজ নিজ ঘরবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন।
এত বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রয়োজনীয় সুবিধা দেয়া থেকে শুরু করে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করারও চাপ মোকাবিলা করতে হবে সিরিয়ার নতুন শাসকদের। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ পরীক্ষায় তারা কতটা সফল হতে পারবেন তার ওপরই নির্ভর করবে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ।
]]>