তবু একদিন, এক অচেনা কণ্ঠ তাকে প্রশ্ন করে, কে সবচেয়ে জ্ঞানী এই দুনিয়ায়? মুসা বলে ফেলেন, আমি। হয়তো একটুও ভাবেননি, একটুও থামেননি। আর তখনই শুনতে পান স্রষ্টার কণ্ঠস্বর, তোমার চেয়েও একজন আছেন, যাকে আমি লাদুন্নি জ্ঞান দিয়েছি, তাঁর নাম খিজির।
সেই মুহূর্তে মুসার ভেতরটা কেমন ঝড়ের মতো কেঁপে ওঠে। কে তিনি? কীভাবে সম্ভব? খোদাবন্দ বলেন, তাঁকে পাবে তুমি দুই নদীর সংযোগস্থলে। তারপর মুসা বলেন, হে খোদা তাঁর কাছে পৌঁছাতে কে আমাকে সাহায্য করবে? খোদাবন্দ বলেন, এক মাছের চিহ্ন। তুমি একটি মাছ ধরে একে থলির মধ্যে রাখো। যেখানে মাছ হারিয়ে যাবে, সেখানেই তিনি থাকবেন।
তারপর এক সকালে মুসা আর তাঁর তরুণ সঙ্গী ইউশা একটা শুকনো মাছ হাতে বেরিয়ে পড়েন। পথ পাথরে ভরা, বাতাসে লবণের গন্ধ। ক্লান্তি যেন হাড়ে হাড়ে জমে ওঠে। একটা জায়গায় তারা বসে একটু জিরিয়ে নেয়। মুসার ঘুম চলে আসে। হঠাৎ সেই মাছটা লাফিয়ে পড়ে নদীতে, হারিয়ে যায় স্রোতের টানে। ইউশা দেখে, মাছটির চলার পথ সুড়ঙ্গের মতো হয়ে গেল, ইউশা অবাক হয়, কিন্তু জানানো ভুলে যায়।
আরও পড়ুন: ইসলামের প্রথম যুগে মুসলমানদের গ্রন্থাগার ব্যবস্থা
ঘণ্টা খানেক পর মুসা ঘুম থেকে উঠে বলেন, খুব ক্লান্ত লাগছে, খাবার দাও। তখনই ইউশার মনে পড়ে, মাছটা শুকিয়ে গেছে। বলে, আমি ভুলে গেছি আপনাকে বলতে। মুসা বলেন, তাহলে তো এই জায়গাটাই আমাদের গন্তব্য। চলো, ফিরে যাই। এরপর দুজনই নিজ নিজ পদচিহ্ন ধরে পেছনের দিকে ফিরে যায়, যখনই তারা মাছের হারিয়ে যাওয়া চিহ্ন খুঁজে পায় তখনই দেখতে পান নদীর ভেতরে সুরঙ্গ পথের শেষে বসে আছেন এক লোক। ধবধবে সাদা জামা, চোখে অপার্থিব আলো, কিন্তু যেন একটা গভীর নীরবতায় ঢাকা।
মুসা বলেন, আপনার প্রতি সালাম ও দরুদ। সালাম শুনে খিজির বলেন, এখানে সালাম এল কী করে? তিনি বললেন আমি মুসা। খিজির জিগ্যেস করলেন, আপনি কি বনী ইসরাইলের মুসা? উত্তরে মুসা বললেন, জি। মুসা বলেন, আপনিই কি সেই ব্যক্তি? যাকে খোদাবন্দ লাদুন্নি জ্ঞান দান করেছেন? আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাই। শিখতে চাই খোদার শেখানো সঠিক জ্ঞান। খিজির বলেন, তুমি পারবে না, তুমি ধৈর্য হারাবে। মুসা বলেন, ইনশাল্লাহ্ আপনি আপনাকে ধৈর্যশীল হিসেবে দেখতে পাবেন। আমি আপনার কোনো আদেশই অমান্য করব না। কথা দিচ্ছি।
তারপর তারা এক গরিব মাঝির নৌকায় ওঠেন। নৌকায় উঠার পর একটি চড়ুই পাখি এসে নৌকার একটি পাশে বসল। পাখিটি দুয়েকবার পানিতে ঠোঁট ডোবালো। খিজির বললেন, হে মুসা, এই পাখিটি তার ঠোঁট দিয়ে নদীর পানি যতটুকু কমিয়েছে, আমার আর তোমার জ্ঞান খোদাবন্দের জ্ঞান থেকে ততটুকুও কমেনি। এরপর হঠাৎ মাঝ নদীতে খিজির নৌকার একটা তক্তা খুলে ফেলেন, ছিদ্র করে দেন নৌকায়। মুসার ভেতরটা কেঁপে ওঠে, আপনি কী করলেন? ওরা তো গরিব মানুষ। এ তো আপনি এক গুরুতর কাজ করলেন। খিজির বলেন, আমি তো আগেই বলেছি, তুমি ধৈর্য রাখতে পারবে না। মুসা চুপ করে যান। নিজের ওপর বিরক্তি, অনুশোচনা জমে থাকে চোখে।
এরপর তারা দুজন নদী পার হয়ে এলেন। পথ চলে, আর এক গ্রামে ঢোকে তারা। রাস্তায় এক কিশোর খেলা করছে, নিষ্পাপ মুখে। খিজির হঠাৎ গিয়ে তাকে মেরে ফেলেন। মুসা এবার আর চুপ থাকতে পারেন না, এটা তো হত্যা। মুসা বলেন, আপনি একটি নিষ্পাপ কিশোরকে হত্যা করলেন? নিশ্চয়ই আপনি একটা অন্যায় করলেন। খিজির বলেন, আবার প্রশ্ন করছো? আমি কি বলিনি তুমি ধৈর্য রাখতে পারবে না? মুসা বলেন, এই শেষ। এবার কিছু বললে আপনি চাইলে আমাকে ছেড়ে দিতে পারেন।
আবার তারা চলতে লাগলেন। শেষবার তারা যায় এক নির্দয় গ্রামের ভেতরে। কেউ দেয় না এক গ্লাস পানি, কেউ দেয় না একটু করো রুটি। তবু খিজির দেখেন একটা ভাঙা দেয়াল, আর সেটাকে মেরামত করতে শুরু করেন। মুসা অবাক হয়ে বলেন, ওরা এমন যে আমরা এলাম, অথচ তারা না দিল খাবার না দিল আতিথ্য। অথচ আপনি ওদের দেয়াল সরিয়ে দিলেন। আপনি চাইলে তো এর বিনিময়ে কিছু পেতে পারতেন।
খিজির তখন থেমে বলেন, তুমি শেষবারের মতো ধৈর্য হারালে। এখানেই তোমার সাথে আমার বিচ্ছেদ হলো। তবে যে ঘটনাগুলোতে তুমি নিজের ধৈর্য রাখতে পারোনি, সেসবের রহস্য তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি। তারপর আমাদের পথ আলাদা হবে।
তখন তিনি তিনটি ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন,
প্রথম ঘটনা: ওই নৌকাটা ছিল কিছু গরিব লোকের। সামনে এক রাজা আসছে, সব ভালো নৌকা কেড়ে নিচ্ছে। আমি ওটাকে ত্রুটিপূর্ণ করে দিলাম, যাতে ওরা বেঁচে যায়।
দ্বিতীয় ঘটনা: ছেলেটা বড় হয়ে কুফরি আর অবাধ্যতায় চলে যেতো, তার বাবা-মা নেককার, ওদের দুঃখ যেন না হয়, তাই আল্লাহ চাইলেন, ওর বদলে আরও ভালো সন্তান পাক।
তৃতীয় ঘটনা: আর দেয়ালের নিচে ছিল এতিম দুই ভাইয়ের ধনভাণ্ডার, তাদের বাবা ছিল একজন ভালো মানুষ। আল্লাহ চেয়েছেন, তারা বড় হলে তাদের হক যেন হারিয়ে না যায়। সবকিছু আমি করিনি নিজের থেকে, সবই খোদাবন্দের হিকমত।
মুসা তখন আর কিছু বলেন না। তিনি বোঝেন, সব জ্ঞান কিতাবে লেখা থাকে না। কিছু জ্ঞান শুধু রুহের নীরব আলোয় জন্মায়। তিনি চেয়ে থাকেন, দূরে কোথাও। চোখে আর কৌতূহল নেই, আছে এক গভীর বিস্ময়ের মতো প্রার্থনা।
]]>