মানুষকে অজান্তেই ধ্বংস করে হিংসা

১ সপ্তাহে আগে
মানুষের অন্তরে এমন কিছু গোপন রোগ বাস করে, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ধীরে ধীরে তা আত্মাকে ভেতর থেকে পুড়িয়ে ধ্বংস করে। তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রোগগুলোর একটি হলো হিংসা। হিংসা এমন এক আগুন, যা অন্যের প্রাপ্ত অনুগ্রহ ও সাফল্যে জ্বলে ওঠে, আর সেই আগুনে শেষ পর্যন্ত হিংসুক ব্যক্তির নিজের অন্তর, তার শান্তি ও নেক আমল ছাই হয়ে যায়।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

 

أَمْ يَحْسُدُونَ النَّاسَ عَلَى مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ তারা কি মানুষকে হিংসা করছে, যেহেতু আল্লাহ তাদেরকে তার অনুগ্রহ থেকে দিয়েছেন? (সুরা নিসা:৫৪) অর্থাৎ, হিংসা আসলে আল্লাহর ফয়সালায় অসন্তুষ্ট হওয়ার নাম। যে ব্যক্তি অন্যের নিয়ামত দেখে কষ্ট পায়, সে মূলত আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত বণ্টনের বিরোধিতা করে।

 

হিংসা মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যার কারণ

 

হজরত আদম আ.-এর দুই পুত্র, হাবিল ও কাবিলের মধ্যে কাবিল তার ভাইকে হিংসা করেছিল। অবশেষে হিংসা ও অহংকার তাকে তার ভাইকে হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করল, ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। (সুরা মায়িদা: ৩০) 

 

আরও পড়ুন: নবীজির প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে মুফতি আবদুল্লাহ তামিমের অনন্য সিরাত গ্রন্থ ‘নবীজির প্রিয় ১০০’

 

এতে প্রমাণিত হয়, হিংসা শুধু একটি মনোভাব নয়, বরং এটি প্রথম হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ, যা মানব সভ্যতায় রক্তপাতের ইতিহাসের সূচনা করেছে। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

 

لَا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا لَمْ يَتَحَاسَدُوا মানুষ ভালো থাকবে, যতক্ষণ তারা পরস্পরের প্রতি হিংসা করতে শুরু করবে না। (মুসনাদ আহমদ:১৪১৩৫) অর্থাৎ, যতদিন মানুষের হৃদয়ে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি থাকবে, সমাজে শান্তি থাকবে। কিন্তু যখন হিংসা ঢুকে যায়, তখন মানুষ সুখে থাকতে পারে না, আর সমাজে অশান্তি, বিভক্তি ও অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে।

 

হিংসার ভয়াবহ পরিণতি

 

১. হিংসা অন্তরকে জ্বালিয়ে দেয়


রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হিংসা এমন আগুনের মতো, যা কাঠকে জ্বালিয়ে ফেলে। (সুনানু আবি দাউদ:৪৯০৩) হিংসুক ব্যক্তি অন্যের উন্নতি দেখে নিজের অন্তরে আগুন জ্বালায়। সে আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়, ফলে তার অন্তর থেকে শান্তি, তৃপ্তি ও বরকত চলে যায়।
 

২. হিংসা আমলকে ধ্বংস করে


রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

 

إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ، فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ হিংসা থেকে বাঁচো, কারণ হিংসা নেক আমলকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয়, যেমন আগুন কাঠকে পুড়িয়ে দেয়। (সুনানু আবি দাউদ: ৪৯০৩) অর্থাৎ, কেউ সারাজীবন নামাজ, রোজা, সাদকা করলেও যদি তার হৃদয়ে হিংসা থাকে, তার আমলের ফলশ্রুতি নষ্ট হয়ে যায়। 

 

৩. হিংসা সমাজে বিভেদ ও শত্রুতা তৈরি করে হিংসুক ব্যক্তি কখনও শান্ত থাকতে পারে না। সে অন্যের ভালোতে সুখ পায় না, ফলে সমাজে ঘৃণা, সন্দেহ ও বিভক্তি জন্ম নেয়। রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, বিদ্বেষ রেখো না, বরং আল্লাহর বান্দা হয়ে ভাই ভাই হও। (সহিহ বুখারি:৬০৬৫; সহিহ মুসলিম:২৫৬৩)

 

হিংসার ঐতিহাসিক পরিণতি

 

১. ইবলিসের পতন, আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে চিরদিনের জন্য বিতাড়িত। ২.কাবিলের অপরাধ, মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যাকারী  যা হিংসার কারণে হয়ে। ৩.হজরত ইয়াকুব আ.-এর সন্তানদের হিংসা, হজরত ইউসুফ আ.-কে কূপে ফেলে দেয়, ফলে বহু বছর তারা অনুশোচনায় পুড়েছিল। ৪.মুনাফিকদের হিংসা, নবীর প্রতি হিংসার কারণে তারা ইসলামকে আড়ালে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছিল। এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে, হিংসা শুধু হৃদয়ের পাপ নয়, এটি ইতিহাস ও সমাজের ধ্বংসের কারণও বটে।

 

আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক ইসলামি বইমেলা: বিদেশি ৪ প্রতিষ্ঠানসহ অংশ নেবে শতাধিক প্রকাশনী

 

হিংসা থেকে বাঁচার উপায়

 

১.আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা (রিযা বিল কদর) যে জানে, আল্লাহ যা দিয়েছেন তা ন্যায়সঙ্গত ও হিকমতের ওপর ভিত্তি করে, সে কখনও হিংসা করে না। ২.অন্যের নিয়ামতের জন্য দোয়া করা রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কারও অনুগ্রহ দেখে “বারাকাল্লাহু লাহু” বলে দোয়া করে, তার অন্তরে হিংসা প্রবেশ করে না।  ৩.আত্মসমালোচনা ও কৃতজ্ঞতা নিজের অবস্থার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা, আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ করা এবং অন্যের দিকে ঈর্ষাভরে না তাকানো,এগুলো হিংসা দূর করে। ৪. হিংসার পরিবর্তে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করা অন্যের উন্নতিকে প্রতিযোগিতার প্রেরণা হিসেবে নিলে সমাজ গড়ে ওঠে ইতিবাচকভাবে।


হিংসা এমন এক অভ্যন্তরীণ রোগ, যা বাহ্যিকভাবে অদৃশ্য, কিন্তু ধীরে ধীরে বিশ্বাস, নেক আমল, সম্পর্ক ও সমাজকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে। হিংসুক ব্যক্তি অন্যের সুখে জ্বলে, কিন্তু নিজের জীবনকেই জাহন্নাম বানিয়ে ফেলে। আল্লাহ তাআলা আমাদের হিংসা থাকার  তাওফিক দান করুন।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন