প্রতিবছর মার্চ এপ্রিল মাসে শুরু হয় গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষের মৌসুম। অন্যান্য বছরের মতো এবারও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষের মৌসুম শুরু হয়েছে। চাষিদের কেউ ঘের প্রস্তুত করছেন, কেউবা পোনা ছাড়ার অপেক্ষায়। কিন্তু মৌসুমের শুরুতেই চাষিরা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি– ভালো মানের, ভাইরাসমুক্ত পোনা পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশের তিনটি এসপিএফ (স্পেসিফিক প্যাথোজেন ফ্রি) হ্যাচারির একটি খুলনায় থাকলেও এটি এ অঞ্চলের বিশাল চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়। স্থানীয়ভাবে ১৪টি সাধারণ হ্যাচারিতে মা বাগদা চিংড়ি থেকে পোনা উৎপাদন করা হলেও মান নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে।
চাষিরা অভিযোগ করছেন, নিম্নমানের পোনা ব্যবহারের ফলে চিংড়ির মৃত্যুহার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। ঘেরে ছাড়ার এক মাসের মধ্যেই এক তৃতীয়াংশ পোনা মারা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে যা অর্ধেকেরও বেশি। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এসপিএফ পোনার সঙ্গে সাধারণ পোনা মিশিয়ে বিক্রি করছেন, যা চাষিদের জন্য আরও বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন: পুকুরে থাকছে না পানি, মাছ সংকট ঠাকুরগাঁওয়ে
বটিয়াঘাটা অঞ্চলের চিংড়ি চাষি আবুল হাসান বলেন, ‘গত বছর আমি তিন লাখ টাকা ঋণ করে চিংড়ি চাষ করি। তবে বছর শেষে আমার মূল বিনিয়োগই উঠে আসেনি। এর প্রধান কারণ, অল্প দিনের মধ্যেই আমার অর্ধেক চিংড়ি মারা গেছে। আমরা টাকা খরচ করে চিংড়ির পোনা ক্রয় করি, তবে সেসব পোনা মান সম্মত নয়।’

একই অঞ্চলের আরেক চাষি খায়ের মল্লিক বলেন, ‘আমি ১০ বছর ধরে চিংড়ি চাষ করছি। আগে পোনা নিয়ে এত সমস্যা ছিল না, কিন্তু এখন ভালো মানের পোনা পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে। বাজার থেকে কিনে আনা পোনা ছাড়ার এক মাসের মধ্যেই প্রায় অর্ধেক মরে যাচ্ছে। এতে আমাদের লোকসান দিন দিন বাড়ছে।’
খুলনার দাকোপ উপজেলার চাষি শামসুল হক বলেন, ‘আমরা ধার-দেনা করে ঘের প্রস্তুত করি, পোনা ছাড়ি। কিন্তু ভাইরাস আক্রান্ত পোনা কিনে ফেললে পুরো বিনিয়োগটাই নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের এলাকায় মানসম্পন্ন হ্যাচারির অভাব, অথচ সরকার থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাই না। যদি ভালো মানের পোনা নিশ্চিত করা যেত, তাহলে আমরা লাভবান হতে পারতাম।’
বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার আরেক চাষি আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমরা নিজেরা চেষ্টা করেও লাভের মুখ দেখতে পারছি না। বাজারে ভালো মানের পোনা নেই। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এসপিএফ পোনার সঙ্গে নিম্নমানের পোনা মিশিয়ে দিচ্ছেন, যা কিনে আমরা আরও ক্ষতির মুখে পড়ছি। সরকার যদি মানসম্মত পোনা সরবরাহ নিশ্চিত করে, তাহলে আমাদের কষ্ট কিছুটা কমবে।’
হ্যাচারি মালিকরা অবশ্য বলছেন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় রোগমুক্ত ও মানসম্পন্ন পোনা উৎপাদন হচ্ছে।

সাউথ বাংলা হ্যাচারির ম্যানেজার অরুণ কান্তি বরুয়া বলেন, ‘আমরা জৈব নিরাপত্তা বজায় রেখে উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। তবে পোনা উৎপাদন বাড়াতে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।’
মাঠ পর্যায়ের মৎস্য কর্মকর্তারা চাষিদের ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধি, পানির গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ এবং জৈব নিরাপত্তার পরামর্শ দিচ্ছেন। বটিয়াঘাটা উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. সেলিম সুলতান বলেন, ‘রোগমুক্ত পোনা উৎপাদন বাড়াতে উন্নত প্রযুক্তি ও নিরাপদ চাষপদ্ধতি অনুসরণ জরুরি।’
মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, চিংড়ি চাষের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করে খুলনা অঞ্চলে আরও এসপিএফ হ্যাচারি স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: এক ভোল মাছের দাম সাড়ে ৩ লাখ টাকা!
খুলনা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এসপিএফ হ্যাচারির সংখ্যা বাড়ানো গেলে আগামীতে পোনার সংকট কমে যাবে এবং চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।
গত মৌসুমে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় প্রায় ১ লাখ ৯৩ হাজার হেক্টর ঘেরে ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ মেট্রিক টন গলদা ও বাগদা চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছিল। কিন্তু চাষিরা আশঙ্কা করছেন, মানসম্পন্ন পোনা নিশ্চিত করা না গেলে আগামীতে উৎপাদন কমে যেতে পারে, যা এই শিল্পকে বড় সংকটে ফেলবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিংড়ি রপ্তানি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাই এই শিল্পকে রক্ষা করতে মানসম্পন্ন পোনার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। দরকার সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ, কঠোর তদারকি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তা না হলে, চিংড়ি চাষ শুধু চাষিদের জন্য নয়, পুরো দেশের অর্থনীতির জন্যই বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।