সবশেষ রাতে টেকনাফের সমুদ্র উপকূল মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাচারের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতকালে ২৯ জনকে উদ্ধার করেছে বিজিবি। এ সময় তিন জন পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়। বিজিবির টেকনাফস্থ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আশিকুর রহমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান জানান, মঙ্গলবার ভোরে রাজাছড়ার দুর্গম পাহাড় থেকে জিম্মিশালা ভাঙ্গায় তাদের কাছে থেকে ছয় জনকে উদ্ধার করা হয় এবং এক জনকে অস্ত্র-গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়। অভিযানের সময় পাচারকারি চক্রের প্রায় আট সদস্য পালিয়ে যাওয়ায় বিজিবি সন্ধ্যায় সমুদ্র উপকূলে নজরদারি বাড়ায়। গভীর রাতে মেরিন ড্রাইভ সৈকতের কৌশলগত একটি পয়েন্টে সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ্য করে একাধিক টহল মোতায়েন করা হয়; পরে সমুদ্রপথে পাঠানোর আগ মুহূর্তে ২৯ জনকে উদ্ধারের পাশাপাশি তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতাররা হলেন: টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশখালীয়া পাড়ার মৃত মোজাহার মিয়ার ছেলে মো. সলিম (৩৫), মৃজিবুর রহমানের ছেলে নুরুল আবছার (১৯) এবং কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের করিমুল্লাহর ছেলে মনসুর আলম (২২)। অভিযান চলাকালে পালিয়ে যাওয়া ৯–১০ জনের মধ্যে তিনজনকে শনাক্ত করেছে বিজিবি; তাদের নাম: মাহমুদুল হক (৩১), সৈয়দুল ইসলাম (৩৭) ও আজিজুল হক (৩০)। অভিযানে ১টি চাকু, ১টি মোটরচালিত সাইকল ও ১টি ইঞ্জিনচালিত সাম্পান নৌকা উদ্ধার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: কক্সবাজারে পলিথিন-প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে তৈরি হচ্ছে আসবাবপত্র
লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, ‘টেকনাফ সীমান্তে সাহসী ও পরিকল্পিত মানবপাচারকারী চক্রের জন্য আজকের দিনটি দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে। ভোরে পাহাড়িক জঙ্গলে জিম্মি উদ্ধার ও সন্ধ্যায় সমুদ্রপথে পাচার ব্যর্থ করার মাধ্যমে বিজিবি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে; পাহাড় থেকে সমুদ্রসীমা পর্যন্ত কোনো অপরাধীর জন্য নিরাপদ জায়গা নেই। মানবতাবিরোধী এই জঘন্য অপরাধ আমরা সহ্য করব না; আমাদের অভিযান ও তল্লাশি অব্যাহত থাকবে।’ উদ্ধার ২৯ জন ভুক্তভোগী প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। গ্রেফতার তিনজনের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে মামলা দাখিলের প্রক্রিয়া চলছে।
অভিযানে গত কয়েক সপ্তাহে আরও একটি উল্লেখযোগ্য সফলতা এসেছে। পাহাড়ের গোপন আস্তানায় অভিযান করে জিম্মি অবস্থায় থাকা ছয় জনকে উদ্ধার করা হয়; অভিযানে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার ও একজনকে আটক করা হলেও দশের মতো পাচারকারী পালিয়ে যায়। সূত্র জানায়, টেকনাফের বাহারছড়া অঞ্চলে কচ্ছপিয়া ও বড়ডেইলসহ বিভিন্ন এলাকায় গোপন বন্দী শিবির তৈরি করে পাচারকারীরা কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন আবদুল আলী (জেলাগৃহে), মো. হোসেন, সাইফুল ও নিজাম; তাদের অধীনে শতাধিক দালাল, মাঝি-মাল্লা ও কিছু রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লোক রয়েছে।
এ বিষয়ে বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফরিদ উল্লাহ বলেন, ‘এই ইউনিয়নের ১৩ হাজার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সন্ধ্যার পর কেউ বাইরে বের হওয়া পছন্দ করে না। এখানে আরো একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চৌকি স্থাপন জরুরি।’ তিনি পর্যটকদেরও মেরিন ড্রাইভে রাতের বেলা একা চলাচল থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এবং বিভিন্ন স্থানে সতর্কতামূলক বার্তা টাঙানোর প্রস্তাব করেছেন।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণও চিন্তাজাগানিয়া: সদ্য প্রকাশিত ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস রিপোর্ট-২০২৫’ বলে, ‘বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার রোধে পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু ন্যূনতম মান পূরণে এখনও ব্যর্থ’। ইউএনএইচসিআর ও আইওএমও পৃথক বিবৃতিতে সতর্ক করেছেন যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাচার বর্তমানে একটি গুরুতর আন্তর্জাতিক ঝুঁকি। রোহিঙ্গা নেতারা জানান, উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়া গমন বা ক্যাম্প ত্যাগের প্রবণতা বাড়ছে; তাদের মধ্যে কিছু দালাল সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ার রুট আবিষ্কার করে, সামাজিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে যুবক-যুবতীদের মোবাইলে নগদ অর্থ প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে ফাঁদে ফেলছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে আগাম ১০-২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে দেড়-দু’লাখ টাকার বাকিতে পাচার সম্পর্কে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
আরও পড়ুন: কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর: খুলছে ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্ভাবনার দ্বার, পর্যটন পাবে নতুন গতি
জেলা পুলিশের তথ্যে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সাগরপথে মানব পাচারের ঘটনায় কক্সবাজারে ১ হাজার ১৩৪ জন মালয়েশিয়া গামীকে উদ্ধার করা হয়েছে; অধিকাংশই রোহিঙ্গা। একই সময়ে উখিয়া-টেকনাফ থানায় ১ হাজার ২০০ জনকে আসামি করে ৮৫টি মামলা করা হয়েছে এবং ৫০০-এরও বেশি পাচারকারী আটক হয়েছে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জায়েদ নুর বলছেন, ‘আমরা মানব পাচার রোধে এবং অপহরণকারীদের ধরতে প্রতিনিয়ত কাজ করছি। তবু অনেক সময় ভুক্তভোগীরা স্বেচ্ছায় দালালদের সাথে মিলে যায়, যা তদন্তে আমাদের জটিলতা তৈরি করে। স্থানীয় পর্যায়ে সক্রিয় পাচারকারীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।’
র্যাব-১৫ এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল কামরুল হাসান বলেন, ‘এই চক্রের সদস্যরা সশস্ত্র এবং পাহাড়ি এলাকা ও সমুদ্রপথ ব্যবহার করে ভিকটিমদের জিম্মি করে রাখে। তারা গুলি চালিয়ে এলাকায় ভয় দেখায়, যাতে নির্বিঘ্নে পাচার চালানো যায়।’
মানবপাচার রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই তৎপরতা সচেতনতা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী সমাধান হবে না বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।
]]>
৪ সপ্তাহ আগে
১০







Bengali (BD) ·
English (US) ·