এসব সমালোচনায় মূলত মাচাদোর বিতর্কিত রাজনৈতিক অবস্থানের পাশাপাশি তার জায়নবাদী ইসরাইল ও গাজায় ইসরাইলি গণহত্যায় সমর্থনের মতো বিষয়গুলো উঠে আসছে। সমালোচকরা বলছেন, গণহত্যায় সমর্থন দেয়া একজন ব্যক্তি কিভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন।
অন্যদিকে তাকে পুরস্কার দিয়ে নোবেল কমিটি ‘শান্তির ওপর রাজনীতিকে প্রাধান্য’ দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় কিছুই করেননি এমন সব মানুষদের নোবেল পুরস্কার দিচ্ছে নোবেল কমিটি।
মারিয়া করিনা মাচাদো কে
৫৮ বছর বয়সি শিল্প প্রকৌশলী মারিয়া করিনা ২০২৪ সালে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী জোটের মনোনীত প্রার্থী হন। কিন্তু দেশটির শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আদালতের মাধ্যমে তার প্রার্থিতা বাতিল করে দেয়। যে কারণে ২০১৩ সাল থেকে দেশটিতে ক্ষমতায় থাকা নিকোলাম মাদুরোকে নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেননি তিনি।
মারিয়া ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভেনেজুয়েলার জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সালে তিনি বিরোধী প্রেসিডেন্টর প্রাইমারিতে প্রার্থী ছিলেন, কিন্তু হেনরিক ক্যাপ্রিলেসের কাছে হেরে যান। ২০১৪ সালের ভেনেজুয়েলার বিক্ষোভের সময় তিনি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন।
আরও পড়ুন: ট্রাম্পকে নোবেলজয়ী মারিয়ার ফোন, বললেন ‘এ পুরস্কার আপনারই প্রাপ্য’
২০২৪ সালের ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ঐক্য প্রার্থী হন মারিয়া করিনা। তবে ২০২৩ সালের জুন মাসে ভেনেজুয়েলার কম্পট্রোলার জেনারেলের এক আদেশ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে রায় বহাল থাকে। যে কারণে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।
মাচাদো করিনা ২০১৮ সালে বিবিসির ১০০ জন প্রভাবশালী নারীর একজন হিসেবে মনোনীত হন এবং ২০২৫ সালে টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে তালিকাভুক্ত হন।
মাচাদোকে নোবেল দেয়া নিয়ে যা বলেছে নোবেল কমিটি
পুরস্কার ঘোষণার সময় নোবেল কমিটি মাচাদোকে ‘শান্তির দূত’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে, তিনি ‘ভেনেজুয়েলায় ক্রমবর্ধমান অন্ধকারের মাঝে গণতন্ত্রের শিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন’। কমিটির চেয়ারম্যান জর্গেন ওয়াটনে ফ্রিডনেস মাচাদোকে ভেনেজুয়েলার এক সময়ে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ‘বিরোধীদের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
নোবেল কমিটি আরও বলেছে, ‘মাচাদো দেখিয়েছেন, গণতন্ত্রের উপকরণই শান্তির হাতিয়ার। তিনি এমন এক ভবিষ্যতের আশা জাগিয়ে তুলেছেন, যেখানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে এবং তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে।’
ফ্রিডনেস বলেন, ‘গত এক বছরে মাচাদোকে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। জীবনের জন্য ভয়াবহ হুমকি থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশ ছাড়েননি; যা লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। যখন স্বৈরশাসকরা ক্ষমতা দখল করে, তখন স্বাধীনতার সাহসী রক্ষকদের স্বীকৃতি দেয়া অত্যন্ত জরুরি।’
সমালোচকরা যা বলছেন
মাচাদোকে নোবেল দেয়ার পর প্রথম বড় কোনো সমালোচনা আসে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ভেনিজুয়েলার বিরোধী নেতাকে পুরস্কার দেয়ায় নোবেল কমিটির কঠোর সমালোচনা করে হোয়াইট হাউস। এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘নোবেল কমিটি শান্তির ওপর রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছে।’
সমালোচনা আসে রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকেও। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ‘শান্তির জন্য কিছুই করেননি এমন লোকদের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। যে কারণে এই পুরস্কার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে তীব্র সমালোচনা চলছে। নোবেল কমিটি মাচাদোর ব্যাপারে যে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করেছে, তার একেবারেই বিপরীত বক্তব্য হাজির করছেন সমালোচকরা।
এক্ষেত্রে মূলত মাচাদোর বিতর্কিত রাজনৈতিক অবস্থান, জায়নবাদী ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যার পক্ষে তার সমর্থনের বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে। তারা বলছেন, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির সঙ্গে তার ভেন্তে ভেনেজুয়েলা পার্টির গভীর যোগাযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন: নোবেল শান্তি পুরস্কার ট্রাম্পকে উৎসর্গ করলেন মারিয়া
অনলাইন অধিকারকর্মীরা বলছেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর মাচাদো ইসরাইলের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এরপর প্রায় দুই বছর ধরে গাজায় গণহত্যা চললেও কখনোই টুঁ শব্দটিও করেননি তিনি। এসব দাবির পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে দেয়া মাচাদোর নানা পোস্ট ও তার স্বাক্ষরিত চিঠিকে প্রমাণ হিসেবে হাজির করেছেন তারা।
মাচাদোর এসব পোস্ট ও চিঠিতে প্রমাণিত যে, তিনি নেতানিয়াহুর একজন ঘনিষ্ঠ মিত্র। যেমন একটি পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘ভেনেজুয়েলার লড়াই মানে ইসরাইলের লড়াই।’ সম্প্রতি এক চিঠিতে ‘ইসরাইলকে ‘প্রকৃত মিত্র’ অভিহিত করে মাচাদো প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি ক্ষমতায় এলে ভেনেজুয়েলার দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেবেন। যা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
যে দেশ থেকে মাচাদোকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে, সেই নরওয়ের একজন সংসদ সদস্য বিয়র্নার মক্সনেস বলছেন, মাচাদো ২০২০ সালে ইসরাইলের লিকুদ পার্টির সঙ্গে একটি সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। আর এই লিকুদ পার্টিই গাজায় গণহত্যার জন্য দায়ী। তাই এই পুরস্কার নোবেলের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে কোনোভাবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মুসলিম অধিকার সংগঠন কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) মাচাদোকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্তকে ‘অবিবেচনাপ্রসূত ও অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছে। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, ‘এই সিদ্ধান্ত নোবেল কমিটির সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে এবং তাদের এটা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।’
বিবৃতিতে বলা হয়, নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির উচিত এমন কাউকে সম্মান জানানো, যিনি নৈতিকভাবে দৃঢ় থেকেছেন এবং সবার জন্য ন্যায়ের পক্ষে লড়েছেন; যেমন সেই শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, কর্মী কিংবা চিকিৎসক, যারা নিজেদের জীবন ও পেশার ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধ গাজায় গণহত্যার বিরোধিতা করেছেন।
নিজ দেশে বিদেশি হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন মাচাদো
অনলাইন অধিকারকর্মীরা মাচাদোর বিভিন্ন পোস্ট ও চিঠির ভিত্তিতে দেখিয়েছেন, মাচাদো বিভিন্ন সময়ে ইরানের পাশাপাশি নিজ দেশ ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন। নোবেল জয়ের পর যা নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে।
২০১৮ সালে ইসরাইল ও আর্জেন্টিনার নেতাদের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে নিজ দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য সহায়তা চান তিনি। চিঠিটি অনলাইনে প্রকাশ করে মাচাদো লেখেন, ‘আজ আমি আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মৌরিসিও মাক্রি এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে চিঠি পাঠাচ্ছি, যাতে তারা নিজেদের প্রভাব ও শক্তি ব্যবহার করে ভেনেজুয়েলার মাদক ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত অপরাধী শাসনব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দিতে সহায়তা করেন।’
তথ্যসূত্র: এনডিটিভি, আল জাজিরা ও মস্কো টাইমস
]]>