ভালোর ছদ্মাবরণে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচার উপায়

৭ ঘন্টা আগে
বনি আদমের সাথে শয়তানের শত্রুতার সূচনা সেই পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে। আল্লাহ তাআলা হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-কে জান্নাতে রাখলেন এবং একটি গাছের ফল না খাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু শয়তান ধোঁকা দিয়ে বলল, তোমাদের রব শুধু এই কারণে নিষেধ করেছেন, যাতে তোমরা ফেরেশতা না হয়ে যাও বা চিরকাল বেঁচে না থাকো। (সুরা আল-আরাফ, ৭:২০)

সে শপথ করে তাদেরকে আশ্বাস দিল, "নিশ্চয়ই আমি তোমাদের একজন কল্যাণকামী পরামর্শদাতা। (সুরা আল-আরাফ, ৭:২১)

 

আরও পড়ুন: যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায়

 

শয়তানের এই প্রতারণায় তারা গাছের ফল খেলেন, ফলে তাদের লজ্জাস্থান প্রকাশ হয়ে পড়ল। এভাবেই শয়তান ভালো পরামর্শের ছদ্মাবরণে প্রথম মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল, যা আজও সে করে যাচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের বেশ কিছু জায়গায় শয়তানকে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন, সুরা ইয়াসিন (৩৬:৬০)-এ আল্লাহ বলেন,

 

আমি কি তোমাদেরকে নির্দেশ দেইনি, হে আদম সন্তানেরা! তোমরা শয়তানের ইবাদত কোরো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। শয়তান আল্লাহর কাছে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল যে, সে মানুষের অন্তরে ধোঁকা সৃষ্টি করবে এবং তাদের সঠিক পথ থেকে সরিয়ে দেবে। সূরা আল-আরাফ (৭:১৬-১৭)-এ শয়তানের কথা উদ্ধৃত হয়েছে:

 

সে বলল, তুমি যেহেতু আমাকে পথভ্রষ্ট করেছ, আমি ওত পেতে থাকব তাদের জন্য তোমার সরল পথে। তারপর আমি অবশ্যই তাদের সামনে থেকে, পিছন থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে আসব, এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেনা।

 

শয়তানের কৌশল ও আমাদের দুর্বলতা

 

শয়তান আমাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশল ব্যবহার করে। তার অন্যতম একটি কৌশল হলো, প্রথমে ভালো চিন্তার মাধ্যমে আমাদের মনকে আকৃষ্ট করা, এরপর ধীরে ধীরে সেগুলোকে বিপথে চালিত করা।

 

উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা নামাজে দাঁড়াই, তখন প্রথমে আমাদের মনে ভালো চিন্তা আসে। কিন্তু শয়তান আস্তে আস্তে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে নেয়। যেমন, হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় দুনিয়াবি কোনো কাজ বা পুরোনো কোনো স্মৃতি। শয়তানের প্রবেশ করিয়ে দেয়া ভালো বুদ্ধির পথ ধরে চিন্তার অলিতে গলিতে সাঁতার কাটতে কাটতে কখন নামাজ শেষ হয়ে যায় আমরা নিজেরাও জানি না।  অথচ এই প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,

 

সফল তারা, যারা তাদের নামাজে বিনয়-নম্র (খুশু-খুজু) অবলম্বন করে। (সুরা মুমিনুন ২৩:১-২)

 

অন্য আরেকটি কৌশল হলো, আমাদের অলস করে দেওয়া। ধরুন, আমাদের হাতে আধা ঘণ্টা সময় আছে, ইফতারের সময় কাছাকাছি। প্রশান্ত আত্মা আমাদের বোঝায়, এখন কোরআন তেলাওয়াত করো, দোয়া-দরুদ পড়ো। কিন্তু শয়তান এসে ফিসফিস করে বলে, তুমি ক্লান্ত, একটু বিশ্রাম নাও, মাগরিবের পর পড়া যাবে। তখন আমরাও ভাবি, হ্যাঁ, কথা তো ঠিক, শরীরটা ক্লান্ত লাগছে, একটু বিশ্রাম নি। কিন্তু যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল স্ক্রলে কাটাই, তখন আমাদের একবারও মনে হয় না যে সময় অপচয় হচ্ছে!

 

শয়তান আমাদেরকে দান-সদকা থেকেও নিরুৎসাহিত করে। যখন দান করার সময় আসে, তখন শয়তান আমাদের মনে ঢুকিয়ে দেয়, এত টাকা দান করার দরকার কী? তোমার ভবিষ্যৎ আছে, সন্তানের ভবিষ্যৎ আছে, একটু কম দাও। অথচ যখন অপ্রয়োজনীয় জিনিসে টাকা খরচ করি, তখন শয়তান আমাদের বুঝ দেয়, তুমি তো পরিশ্রম করো, ভালো কিছু কেনার অধিকার তোমার আছে! এই বয়সে যদি আনন্দ বিনোদন না করো কখন আর করবে ? তাইতো দান সদকা করার সময় দশ টাকা আমাদের কাছে অনেক টাকা মনে হয় কিন্তু শপিং করতে গেলে ১০-২০ হাজার টাকাও আমাদের কাছে কিছু মনে হয় না।

 

আল্লাহ তায়ালা বলেন, শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে কু-কাজের আদেশ দেয়। (সুরা বাকারা ২:২৬৮)

 

শয়তানের ফাঁদ থেকে বাঁচার উপায়

 

১. আখিরাতের কথা বেশি বেশি চিন্তা করা: আমরা যখন মৃত্যু ও পরকালীন জীবন নিয়ে চিন্তা করবো, তখন দুনিয়ার মোহ আমাদের ওপর কম প্রভাব ফেলবে। ২. আবেগের চেয়ে বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া: দুনিয়ার স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা ভুলে যাই, অনেকেই এসব স্বপ্ন দেখেই কবরে চলে গেছেন।  তাই আমাদের উচিত বাস্তবতাকে গ্রহণ করা এবং জীবনকে পরকালের জন্য প্রস্তুত করা।

 

৩. নফল ইবাদতকে নিজের অভ্যাসে পরিণত করা: শুধু ফরজ ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রতিদিন কিছু নফল ইবাদত বাধ্যতামূলক করে নেওয়া উচিত। উদাহরণ স্বরূপ প্রতিদিন কমপক্ষে ১২/১৪ রাকাত নফল আদায় করা।


৪. কুরআনের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা: প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াত করা, কিছু অংশ মুখস্থ করা এবং এর অর্থ বোঝার চেষ্টা করা।

 

৫. স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা: শয়তান আমাদের সময় নষ্ট করার জন্য মোবাইল ও ইন্টারনেটকে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবহার সীমিত করা এবং অপ্রয়োজনীয় ব্রাউজিং এড়ানো জরুরি। প্রয়োজনে কেনার সময় লিমিটেড ডাটা ক্রয় করা।


৬. সৎ মানুষের সংস্পর্শে থাকা: আল্লাহ বলেন, 

 

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও। (সুরা তওবা ৯:১১৯) 

 

৭. নিয়মিত জিকির ও ইস্তিগফার করা: আল্লাহর স্মরণ আমাদের হৃদয়কে শুদ্ধ করে এবং শয়তানের ধোঁকা থেকে রক্ষা করে। চলতে ফিরতে জিকিরের অভ্যাস একদিকে যেমন পরকালে পুণ্যের পাহাড় গড়ে দিবে অপর দিকে হৃদয়ে তৈরি করবে অপার্থিব প্রশান্তি।

 

জেনে রাখ, আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমেই অন্তর প্রশান্ত হয়। (সুরা রাদ ১৩:২৮)

 

আরও পড়ুন: রোজাদারের ১০ ফজিলত

 

শয়তান আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধোঁকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। কিন্তু আমরা যদি সচেতন থাকি, আল্লাহর ওপর ভরসা করি, কুরআনের শিক্ষা মেনে চলি এবং ভালো কাজের প্রতি মনোযোগী হই, তাহলে ইনশাআল্লাহ আমরা শয়তানের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবো। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শয়তানের ফাঁদ থেকে বাঁচার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক: ইমাম, ধর্ম মন্ত্রণালয় দোহা কাতার।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন