জানা যায়, খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালি ইউনিয়নে ঝপঝপিয়া নদীর পাড় ঘেঁষে কোথাও ধস, আবার কোথাও দীর্ঘ ফাটল। এমন চিত্র খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন নদীর তীরের অন্তত ৫০টি পয়েন্টে। বর্ষা ও ঘূর্ণিঝড় মৌসুম সামনে রেখে নতুন করে এসব ভাঙন পাওয়া যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে এ তিন জেলায় অন্তত ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। এতে নদীপাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা।
খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালি ইউনিয়নের জাবেরের খেয়াঘাট নামের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝপঝপিয়া নদীপাড় ঘেঁষা বাঁধেও ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে ধস ও ফাটল।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্যমতে, একটু ভারি বৃষ্টি হলেই নদীর পানি বেড়ে বাঁধের পাশে পানি চুঁইয়ে পড়ে। সেখানে আবার যদি জোয়ার বা ঘূর্ণিঝড় আসে, তাহলে পুরো এলাকা ভেসে যাবে—এমন আশঙ্কা করছেন তারা। চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বেড়িবাঁধটি।
আরও পড়ুন: আশাশুনির গোয়ালডাঙ্গা এলাকায় বেড়িবাঁধে ভয়াবহ ভাঙন
সাতক্ষীরার আশাশুনিতে কয়েক দিন আগে ভেঙে যায় এমনই একটি ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ। এতে তলিয়ে যায় অন্তত ২০টি গ্রাম, ক্ষতিগ্রস্ত হয় চার শতাধিক চিংড়ি ঘের। ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা বলে সরকারি তথ্যে উঠে এসেছে।
সাতক্ষীরা আশাশুনি ইউনিয়নের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে দক্ষিণের তিন জেলার ৭ উপজেলার ১০ ইউনিয়নের বাসিন্দারা।

তথ্য অনুযায়ী, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় মোট দুই হাজার ৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার ২১টি পয়েন্ট, এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির ২৯টি পয়েন্টে নতুন ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় নদী পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা।
দাকোপের পানখালি ইউনিয়নের রোকেয়া বেগম বলেন, ‘ঘরের পেছনে বাঁধ, তার পাশে নদী। বাঁধে ফাটল, মাটি সরে গেছে। রাতে ঘুমাতে পারি না, ভয় হয় কখন যে পানি ঢুকে পড়ে।’
৬৫ বছর বয়সী আব্দুল খালেক গাজীও দাকোপের পানখালি ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘বাঁধ ভাঙলে শুধু ঘর না, জীবনটাই ভাঙে। এত বছর ধরে শুধু শুনে আসছি বাজেট আসবে, বাঁধ হবে। কিন্তু দুর্যোগ আসলে আবার সব ভেসে যায়।’
আরও পড়ুন: ঈদ আনন্দেও ভাঙন আতঙ্ক!
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দান চাই না, ভিক্ষাও চাই না—শুধু চাই একটা টেকসই বাঁধ, যাতে নিজের ঘরে নিরাপদে ঘুমাতে পারি।’
আশাশুনির খাজরা গ্রামের বৃদ্ধ আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমার বয়স ৬৫ বছর। জীবনে অনেক ঝড় দেখেছি, কিন্তু গত বছর যা দেখলাম—তা ভয়ঙ্কর। বাঁধ ভেঙে আমাদের পুরো গ্রাম তলিয়ে গিয়েছিল। একটা ছাগল পর্যন্ত বাঁচাতে পারিনি। এখন আবার শুনি বাঁধে ফাটল, রাতে খাটে ঘুমাতে পারি না। এই বয়সে আর কতদূর দৌড়াতে পারব বলুন?’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সংস্কারে ব্যয় হয়েছে ২৮৭ কোটি টাকা। কিন্তু যেসব জায়গায় এই টাকা খরচ করে সংস্কার করা হয়েছে, সেসব জায়গাতেই বছর না ঘুরতেই আবার ভাঙন দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই সংস্কার প্রকল্পে স্থায়িত্ব নেই, স্বচ্ছতাও নেই। দাকোপের ঘাটাখালী এলাকার কৃষক আমিরুল শেখ বলেন, ‘কন্ট্রাক্টর আসে, কিছু বালু ফেলে যায়, ছবি তোলে, চলে যায়। এক বছরের মাথায় আবার সেই বাঁধ ভাঙে। কোটি কোটি টাকা খরচ হয়—কিন্তু বাঁধ ঠিক থাকে না।’
আরও পড়ুন: নতুন বাঁধে ভাঙন, ১৬ কোটি টাকাই জলে!
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, প্রতিবছর দুর্যোগ মৌসুম ঘনিয়ে এলেই পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছুটা তৎপর হয়। কিছু বালুর বস্তা ফেলে, কিছু জরুরি কাজ করে—কিন্তু স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধানে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয় না।
দাকোপ উপজেলার পানখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাব্বির হোসেন বলেন, ‘নামমাত্র সংস্কার করে দায় সারা হয়। বর্ষা গেলেই সব থেমে যায়। এভাবে উপকূল রক্ষা করা সম্ভব নয়।’
চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা হচ্ছে জানিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা জানান, বাঁধ সংস্কারে আমাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে জরুরি মেরামতের কাজ শুরু করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়া চলছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলজুড়ে লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা টিকে আছে এই বেড়িবাঁধ ঘিরেই। কিন্তু বছর বছর একই চিত্র, একই ধ্বংসযজ্ঞ, আর সেইসঙ্গে হারিয়ে যায় মানুষের স্বপ্ন।
উপকূলের মানুষ বলছে, স্বল্পমেয়াদি সংস্কার নয়, এখন দরকার দীর্ঘমেয়াদি, বিজ্ঞানভিত্তিক ও টেকসই বেড়িবাঁধ—যা শুধু ঘূর্ণিঝড় ঠেকাবে না, উপকূলীয় জীবনের জন্য নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলবে।