যে নদী দেখে আলেকজান্ডার, টলেমি কিংবা হিউয়েন সাংয়ের কলম দোর্দণ্ড প্রতাপে লিখেছে বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস, সেই নদী আবারও হয়েছে নবযৌবনা। জেগেছে প্রাণ। আর তাতে পাল তুলেছে ডিঙি নৌকা। ভরা কটালের উত্তাল ঢেউ যেন দিচ্ছে শুষ্ক মৌসুমে নির্মম নির্যাতনের হাজারো নালিশ।
রিপন নামের এক যুবক পরিবার নিয়ে নৌকায় চড়ে ঘুরতে এসেছেন বুড়িগঙ্গায়। জানালেন, বর্ষার কারণে এখন পানি একদম পরিষ্কার। কোনো গন্ধও নেই। তারাও ঘুরে অনেক আনন্দ পেয়েছেন।
তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু কিংবা ধলেশ্বরী, আষাঢ় শ্রাবণের অঝর ধারা যেন নদীকদম্বে করেছে প্রাণপ্রতিষ্ঠা। তিলোত্তমা ঢাকা হয়েছে স্রোতস্বিনী নদীবেষ্টিত পুরানো সেই প্রাণের শহর।
কিন্তু কিছুদিন বাদেই আবার কুৎসিত হবে নদীর পানি, দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসবে। সেই চিন্তায় আফসোসের শেষ নাই নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের।
মন্ডল মাঝি বলেন, ‘পরিষ্কার পানিতে এখন গোসল করা যায়। তবে কিছুদিন পর পানি কমে গেলে পচা গন্ধ বের হবে।’
এসব নদী এখন আর কালীদাসের কাব্যের মতো সর্বদা বয়ে চলা প্রমত্তা কোনও জলপ্রবাহ নয়। সময়ের বিবর্তনে বদলেছে এর রূপ, বদলেছে নদীতটের জীবনযাত্রা।
তবে কাঁটাতারের বেড়াজালে যেমন বন্দি হয় মানব জীবন, ঠিক তেমনি শুষ্ক মৌসুমে নদী বন্দি হয় শুধু গুটিকয়েক মানুষের সচেতনতার স্লোগানে। রাজধানীর আশপাশের নদীতে প্রতি লিটার পানিতে থাকে মাত্র ০.৫ থেকে ৩.৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন। যেখানে নিকষ কালো পানিতে হারিয়ে যায় নদীবক্ষের অপার সৌন্দর্য্য। নদী দূষণে ভাঙে খাদ্যশৃঙ্খল।
সত্তরোর্ধ্ব রিয়াজ মাঝি জানান, আগে অনেক জাতের মাছ ঢাকার এই নদীগুলোতে পাওয়া যেত। কিন্তু দূষণের কারণে এখন আর আগের মতো মাছ মেলে না।
দূষণের এই প্রতিযোগিতা চলছে বছরের পর বছর ধরে। তবে এখনো আছে প্রসাশনের নির্লিপ্ততা। দীর্ঘ সময় পেরোলেও দৃষ্টান্ত স্থাপনে ব্যর্থ দায়িত্বশীলরা এখনো দিচ্ছেন জনবল সংকট কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দোহাই।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি দু-একটা জায়গায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করি। এজন্য আপাতত তুরাগ নদকে বেছে নিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মনিটরিং সক্ষমতা খুবই সীমিত। সেইসঙ্গে বর্তমানে দেশের সার্বিক যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, এ অবস্থায় অভিযানে যাওয়া নিয়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।’
নদী দূষণ নিয়ে পরিবেশ অধিদফতরকেই দায়ী করছেন পরিবেশবিদ মো. আবদুস সোবহান। তার মতে, অধিদফতরের মূল দায়িত্ব পালন করতে আসা কর্মকর্তাদের তালিকা দীর্ঘ হয়েছে ঠিকই, তবে প্রাপ্য বুঝে পায়নি নদী।
তিনি বলেন, ‘নদী দূষণ ঠেকাতে একসঙ্গে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে পরিবেশ অধিদফতর, স্থানীয় সরকার, বিআইডব্লিউটিএসহ সবাইকে। তবেই নদী বাঁচবে, সেইসঙ্গে বাঁচবে জীববৈচিত্র্যও।
]]>