বিয়ারিং প্যাড কী, কেন বসানো হয়—কীভাবে খুলে পড়লো?

৩ সপ্তাহ আগে
আবারও খুলে পড়েছে মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড। এক পথচারীর মাথায় পড়ায় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরেও একবার এমন ঘটনা ঘটেছিলো। খালি জায়গায় পড়ায় সেবার কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। একাধিকবার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

বিয়ারিং প্যাড কী, কেন লাগানো হয়?

 

বিয়ারিং প্যাড সাধারণত বড় সেতু, ফ্লাইওভার, উচ্চ ভবনের কলামের নিচে ব্যবহার করা হয়। সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় রাবার বিয়ারিং প্যাড (Elastomeric Bearing Pad)।


মেট্রোরেলের উড়াল লাইনের মতো স্থাপনার জন্য সাধারণত নিওপ্রিন রাবার নামে এক ধরনের সিন্থেটিক উপাদান দিয়ে বিয়ারিং প্যাড তৈরি করা হয়; কখনো কখনো ন্যাচারাল রাবারও ব্যবহার করা হয়, তবে নিওপ্রিন বেশি টেকসই। এটি তাপ, পানি, তেল ও বৈরি আবহাওয়া প্রতিরোধী।

 

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্রে জানা যায়, মেট্রোরেলের নিচের পিলারের সঙ্গে উড়াল পথের সংযোগ স্থলে বসানো বসানো হয় রাবারের বিয়ারিং প্যাড।

 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক সময় নিউজকে বলেন, বিয়ারিং প্যাড শুধু রেললাইনের জন্য না, সড়কের জন্যও ব্যবহার করা হয়। কম্পন প্রতিরোধের জন্য এটি বসানো হয়। কম্পনটা ঠেকানোর পাশাপাশি স্থাপনার স্থায়ীত্ব বাড়ানোর জন্য শক অ্যাবজরভার হিসেবে এটি দিতে হয়। এটা নির্মাণেরই একটা অংশ।

 

ট্রেনের ক্ষেত্রে এটার গুরুত্ব বেশি। কারণ, এর লোডিং প্যাটার্নটা আলাদা। ট্রেন চলা এবং গাড়ি চলার মধ্যে লোডিং প্যাটার্নের পার্থক্য আছে। ট্রেনের চাকাগুলো ডাইনামিক লোড দেয়। তাই কম্পন মোকাবিলা করে স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য, আশপাশের শব্দ কমানোর জন্য বিশেষ ধরনের রাবারের বিয়ারিং দেয়া হয়।

 

পাঁচ সপ্তাহের ব্যবধানে মেট্রো লাইনের বিয়ারিং প্যাড দুইবার খসে পড়া এবং এতে প্রাণহানির পর এর কাঠামো ও কাজ নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল জন্মেছে। অনেকে জানতে চাচ্ছেন, রাবারের তৈরি হলে এর আঘাতে মানুষ কেন মারা যায়?

 

ডিএমটিসিএলের সূত্র জানিয়েছে, রাবারের হলেও আসলে এই প্যাড অনেক ভারী হয়। এগুলোর প্রতিটির ওজন ৫০ থেকে ১৫০ কেজি।

 

কেন খুলে পড়লো?

 

মেট্রোরেলের লাইনে স্থাপিত বিয়াং প্যাডগুলো কয়েক টন ওজন এবং ধারাবাহিক কম্পন সহ্য করার জন্যই তৈরি। তাই সেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় খুলে পড়া প্রায় অসম্ভব।

 

এ বিষয়ে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, মেট্রোর বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ার কথা না।

 

তিনি জানান, আন্তর্জাতিক কম্প্লায়েন্সের আওতায় এলিভেটেড মেট্রো করা হয়েছে। সব কিছু কিন্তু স্ট্যান্ডারাইজ করা হয়েছে।

 

তবে কাজটা যারা বুঝে নিয়েছেন, তারা হয়তো ঠিক মতো বুঝে নিতে পারেননি বলে মনে করেন তিন।

 

এই পরামর্শকদের অনেক টাকা দিয়ে জাপান থেকে নিয়ে আসা হয়েছে, তাদের ওপর আমরা বিশ্বাস রেখেছিলাম। মনে হয় আমাদের দেশের পক্ষে কাজটা ঠিক মতো বুঝে নেয়া হয়নি।

 

আরও পড়ুন: নিহত যুবকের পরিবারের সদস্যকে মেট্রোরেলে চাকরি দেয়া হবে: ফাওজুল কবির

 

বিশেষজ্ঞদের বরাতে কিছু সংবাদমাধ্যমে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ভায়াডাক্টের নকশাগত ত্রুটির কথা। তারা বলছেন, প্যাডকে পিলারের সঙ্গে আটকে রাখার ব্যবস্থা না থাকায় তা খুলে পড়েছে।

 

অধ্যাপক শামসুল হকের মতে, যে পদ্ধতি এবং স্পেসিফিকেশনে পুরো পৃথিবীতে নিরাপদ অবকাঠামোর জন্য বিয়ারিং প্যাড লাগানোর কথা, সেটা বুঝে নেয়া হয়নি।

 

আমি বলবো, ডিজাইনে কোনো ঘাটতি থাকার কথা না। কারণ, ডিজাইন কেউ নিজের ইচ্ছা মতো করতে পারে না। নিরাপদ করার জন্য এখানে সব কিছু বলা থাকে- কীভাবে এটাকে প্ল্যান করতে হবে, নির্মাণ করতে হবে এবং নির্মাণের পর কীভাবে বুঝে নিতে হবে

 

দুর্ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমদ। তার কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান, সেপ্টেম্বরে ঘটনার পর তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা হয়েছিল কি না। হয়ে থাকলে আবার কেন এ ঘটনা ঘটল?


জবাবে তিনি বলেন, “আগের কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী সমস্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। সবগুলো পিলার ফিজিক্যালি এক্সপার্ট দিয়ে পরিদর্শন করা হয়েছিল।”


তিনি যখন এই কথা বলছিলেন, পাশেই ছিলেন সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। আঙ্গুল তুলে তিনি প্রশ্ন করেন, “তাহলে এটা হলো কীভাবে?” ওই ঘটনায় কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কি না, জানতে চান সংবাদকর্মীরা।


জবাবে ডিএমটিসিএলের এমডি ফারুক বলেন, “তখন বলা হয়েছিল ডিফেক্ট লাইবেলিটি পিরিয়ডের মধ্যে এই ঘটনা ঘটেছে। তাই ওই বিষয়টি সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল তাদেরকে (ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে)। তারা তখন বলেছে, তারা সেটা সংশোধন করেছে।


এ সময় উপদেষ্টা ফাওজুল বলেন, “এটা জাপানি ঠিকাদাররা করেছে। এখানে বলা হচ্ছে এটা ডিফেক্ট লাইবেলিটি পিরিয়ডের মধ্যে ঘটেছে। তবে এখন যে কমিটি হচ্ছে এই কমিটি আগের কমিটির রিপোর্টও দেখবে।”

 

আরও পড়ুন: মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে নিহত ব্যক্তির পরিচয় মিলেছে

 

খরচ বেশি, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কম

 

ডিএমটিসিএলের সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মেট্রোরেল প্রকল্পগুলোর খরচ সবচেয়ে বেশি। ভারতে এক কিলোমিটার মেট্রোরেলের নির্মাণ খরচ মাত্র ৪০.৭৭ মিলিয়ন ডলার। রিয়াদে তা ১৬৬ মিলিয়ন ডলার, দুবাইয়ে ১৮৮ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু ঢাকায় একই ধরনের প্রকল্পের প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২২৬.৭৪ থেকে ২৫৩.৬৩ মিলিয়ন ডলার।

 

অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, জাপানিদের মতো এত ব্যয়বহুল এবং বিজ্ঞ পরামর্শক— তারাও যদি গাফিলতি করে এবং তাতে হতাহতের ঘটনা ঘটে তাহলে সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। খরচটা কিন্তু কম হয়নি। আমরা টাকা তো কম দিইনি। আমাদের খরচও বেশি হয়েছে, কাজ বুঝে নেয়ার জন্য অনেক টাকা দিয়ে পরামর্শক জাপান থেকে নিয়ে এসেছি, তারপরেও যদি এই অবস্থা হয়— এখানে কাউকে না কাউকে দায় নিতে হবে। কারণ, এখানে হতাহত হয়েছে এবং ঘটনা রিপিট করেছে। রিপিট হওয়া মানে হলো সিস্টেমের মধ্যে দুর্বলতা আরও আছে।

 

পরপর দুইটা ঘটনা রিপিট হওয়ার মানে হলো পুরো সিস্টেমের মধ্যে দুর্বলতাটা রয়ে গেছে, অন্য জায়গাওয়াও লুজ আছে কিনা তা নিয়ে বিরাট সন্দেহ রয়ে গেছে।

 

‘গুণগত মান বজায় রেখে টাকা ছাড় দেয়ার কাজটা যার ছিলো, সেই পরামর্শককে দায় নিতে হবে। এই সরকারকে একটা মেসেজ দিতে হবে যে, টাকা নিবা বেশি কিন্তু কাজ হবে না সেটা হবে না।’, যোগ করেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এ অধ্যাপক।

 

পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন

 

রোববার দুপুর ১২টার দিকের মেট্রোরেলের ৪৩৩ নাম্বার পিলারের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন পথচারী আবুল কালাম। হঠাৎ একটি বেয়ারিং প্যাড খুলে সরাসরি তার মাথায় আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। আবুল কালামের সঙ্গে থাকা পাসপোর্ট থেকে জানা যায়, তিনি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কিশোরকাটি গ্রামের বাসীন্দা। তার বয়স ৩৫ বছর।


এই ঘটনায় আহত হন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরও দুজন। তাদেরকে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়।


ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন, সেতু ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।


কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফকে। বাকি সদস্যরা হলেন: বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহিদুল ইসলাম এবং ডিএমটিসিএলের লাইন-৫-এর প্রকল্প পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব। উপসচিব আসফিয়া সুলতানা কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
 

কমিটি পূর্ববর্তী দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধকল্পে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা প্রস্তুত এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করাও কমিটির কাজের অন্তর্ভুক্ত। কমিটিকে আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পেশ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন