গত ১৮ অক্টোবর দুপুর সোয়া ২টায় বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিটসহ পুলিশ, র্যাব, আনসার, এপিবিএন, বিমান ও নৌবাহিনীর সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে একযোগে কাজ করেন। সাত ঘণ্টা পর রাত সোয়া ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানায় পায়ার সার্ভিস।
ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
ফুটে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
এই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ’স্কাইবাই বিডি’। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় দুই কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও রাসেল বিন আহাদ। তিনি বলেন, বিমানবন্দর কার্গো শেডে আগুনে স্কাইবাই বিডির দুই কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এটি শুধু প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, হাজার হাজার গ্রাহকের জন্যও ক্ষতি।’
আরও পড়ুন: একের পর এক আগুন: পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে বিদেশে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের চেষ্টা নয় তো?
শুধু ’স্কাইবাই বিডি’ই নয় কার্গো ভিলেজের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ই-কমার্স উদ্যোক্তা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ফেসবুকে পণ্য বিক্রি করা প্রতিষ্ঠান অবসেশন জানায়, বিমানবন্দরের আগুনে ১১ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই শিপমেন্টটি রিসিভ করতে পারলে অনেক বেশি আয় হতো, সেই দিক থেকে দেখতে গেলে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। আবার শিপমেন্ট আসা পর্যন্ত আমাদের ফাইনানশিয়ালি আরও অনেক পিছিয়ে পরতে হবে। তাই এই ক্ষয়ক্ষতির আসলে একদম সঠিক পরিমাণে বলা সম্ভব না।
বেনজির ডায়েরি নামে ব্যাবসা পরিচালনা করেন নারী উদ্যোক্তা বেনজির মুন্নি। শাহজালালের আগুনে পুড়েছে তার ভাগ্যও। তিনি জানান, বিমানবন্দরের এই কার্গো সেকশনটি দেশের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান। দেশের আমদানিকৃত সমস্ত মালামাল এখানে রাখা হয়, আর আগুনে তা ধ্বংস হয়ে যাওয়া সত্যিই অপ্রত্যাশিত এবং উদ্বেগজনক। প্রায় ১৭-১৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৩০-৩৫ কার্টন পণ্য ছিল; সবই স্কিন কেয়ার, হেয়ার কেয়ার। সামনে শীতের সিজনের জন্য স্টক করে রাখা প্রোডাক্ট। যা দুবাই, চায়না, থাইল্যান্ড থেকে এসেছিল।
অগ্নিকাণ্ডে বড়বড় প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতিও ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে টাকার অঙ্কে। বিজিএপিএমইএর সভাপতি মো. শাহরিয়ার জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত যে লিখিত রিপোর্ট এসেছে, তাতে সংস্থার মেম্বারদের ২৩ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে।
বিকেএমইএ ও এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বা ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। কার্গো ভিলেজের মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে যে এটি কতটা অনিরাপদ। কয়েক বছর ধরেই আমরা রফতানিকারকেরা অভিযোগ করে আসছি, আমাদের পণ্য খোলা জায়গায় রাখা হয়; যা নিরাপত্তার দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ড. মো. জাকির হোসেন জানিয়েছেন, শুধু কাঁচামালের দামই ২০০ কোটি টাকার উপরে। এছাড়া এআইটি ও ভ্যাটের হিসাব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতি ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে পৌঁছাবে। তবে ঠিক কত টাকার মালামাল পুড়েছে তা এখনও সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।
ব্যবসায়ীদের আশার আলো ‘বিমা’!
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই কোনো বিমা করা ছিল না। ফলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। নারী উদ্যোক্তা বেনজির মুন্নি বলেন, ‘আমরা যারা ছোট উদ্যোক্তা, সাধারণত আমাদের কোনো বিমা থাকে না। আমরা প্রোডাক্টগুলো ডোর-টু-ডোর কালেক্ট করার জন্য যে এজেন্সির সঙ্গে কাজ করি, সেই এজেন্সির এলসির মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করি। সাধারণত এজেন্সিগুলো সামান্য বিমা বা ইনস্যুরেন্স রাখে, আর সেই পেমেন্ট তারা পেয়ে থাকে। আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি হলো, আমরা ডিএইচএল কুরিয়ারের মতো শুধুমাত্র সেবা নিই, তাই আমাদের কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।’
তবে যে সব প্রতিষ্ঠানের বিমা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা কিছুটা সহজ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু কোনো গোঁজামিল তথ্যের ভিত্তিতে বিমা কোম্পানিগুলো যুক্তি দাঁড় করালে তা ব্যবসায়ীরা প্রত্যাখ্যান করবেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘কোনোভাবেই তালবাহানা করে বিমার ক্লেইম পরিশোধে বিলম্ব করা যেন না হয়। আমরা অনুরোধ করব সরকার যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। অন্তত আমি অর্থ উপদেষ্টা, বাণিজ্য উপদেষ্টাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করব।’
বিমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলিসির শর্ত কাভার করা থাকলে সহজেই দাবির টাকা পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম নুরুজ্জামান বলেন, ‘ইনস্যুরেন্স ব্যাবসার একটি অংশ। যদি এটি ১০০ শতাংশ প্রদানের আওতায় থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীরা নিরাপদ থাকতে পারেন। বিমা কোম্পানিগুলো টাকা দেবে। সাধারণ বিমার একটি অংশ রিইনস্যুরেন্সের মাধ্যমে থাকে; বিদেশি কোনো কোম্পানির সঙ্গে রিইনস্যুরেন্স থাকলে সেটিও পাবে।’
বিমার আওতায় থাকা পণ্য ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপে এরমধ্যেই কাজ শুরু করেছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। মুখপাত্র সাইফুন্নাহার জানিয়েছেন, ‘অনেক সময় রিইনস্যুরেন্স থাকলে সাধারণ বিমা করপোরেশনের সঙ্গে কিছুটা সময় লাগে। এই পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলো প্রাথমিকভাবে নিজেদের অর্থ দিয়ে ক্ষতি পূরণ করে এবং পরে কাগজপত্রে হিসাব মিলিয়ে নেন। এতে ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষতির বিষয়টি দ্রুত মোকাবিলা করা যায়। আইডিআরএ লস দ্রুত কাভার করার নির্দেশনা দেবে, যাতে ক্লেইমগুলো দ্রুত সেটেল হয়।’
সমস্যা সমাধানে ব্যবসায়ীদের পরামর্শ
’স্কাইবাই বিডি’র সিইও রাসেল বিন আহাদ বলেন, পণ্য দেশে প্রবেশের পর সব প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ সত্ত্বেও পণ্যটি সর্বশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের গোডাউনে থাকাকালীন ধ্বংস হয়েছে; তাই পরিশোধিত সম্পূর্ণ ট্যাক্স ফেরত দিতে হবে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের ত্রুটির কারণে সংঘটিত এই বিপুল ক্ষতির দায় স্বীকার করে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
আরও পড়ুন: কার্গো ভিলেজে আগুন: বিমা পলিসির শর্ত ঘিরে নয়-ছয়ের শঙ্কা!
অবসেশন জানায়, দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা চাই, ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক। যাতে কারও কষ্টে উপার্জিত টাকা দিয়ে আমদানি করা মালামাল চোখের সামনে পুড়ে না যায়। আমদানি-রফতানি হলো দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার অন্যতম হাতিয়ার। তাই ব্যবসায়ীদের কাছে মালামাল সময়মতো পৌঁছানো নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সেক্টরে কোনো ধরনের ডিলে বা অবহেলা কখনও গ্রহণযোগ্য নয়।
নারী উদ্যোক্তা বেনজির মুন্নি বলেন, দেশের অর্থনীতি মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। আর সেই ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ এমনভাবে পুড়ে যাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগের বিষয়। তাই দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে আগুন লাগার প্রকৃত কারণ বের করে আনতে হবে। একই সঙ্গে শুধু বিমানবন্দর নয়, দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যত দ্রুত সম্ভব কার্গো ভিলেজের বিকল্প স্থান নির্ধারণ করে ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ ব্যাবসা নির্বিঘ্ন রাখতে হলে পণ্যের আমদানি-রফতানির সময়সীমা আরও কমাতে হবে।
তার মতে, উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি-তাদের জন্য সরকারের উচিত একটি বিশেষ রেজিস্ট্রেশনভিত্তিক সহায়তা ব্যবস্থা চালু করা, যাতে এমন ক্ষতির সময় দ্রুত সহযোগিতা পাওয়া যায়।
]]>
৪ সপ্তাহ আগে
৭







Bengali (BD) ·
English (US) ·