নাইটিঙ্গেল একাধারে আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত, লেখক ও পরিসংখ্যানবিদ। যাকে ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’(হাতে নিয়ে আলোকবর্তিকা) বলা হয়। নার্সিংয়ের ক্ষেত্রে তার যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলো সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আজও মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ১৮২০ সালের ১২ মে ইতালির ফ্লোরেন্স নগরীর এক অভিজাত ও ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা-মাতা ছিলেন উইলিয়াম শোর নাইটিঙ্গেল ও ফ্রান্সেস নাইটিঙ্গেল। খুব অল্পবয়স থেকেই ফ্লোরেন্স মানব সেবার মতো মহৎ কাজের জড়িয়ে পড়েন। সমাজসেবা ও মানবসেবায় নিজের ভূমিকা রেখেছেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।
ছোটবেলা থেকেই নাইটিঙ্গেল খেয়াল করতে শুরু করেন তার আশপাশের গ্রামগুলোর গরিব ও অসুস্থ রোগীদের। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি উপলব্ধি করেন, সমাজের মঙ্গলের জন্য সেবিকা হওয়ার ব্রত নিয়েই তাকে এগিয়ে যেতে হবে। এ উপলব্ধিই এক ধরনের আধ্যাত্মিক সাধনা হিসেবে কাজ করেছে নাইটিঙ্গেলের জীবনে।

ভিক্টোরিয়ান যুগে তার মতো ধনী ও অভিজাত পরিবারের একজন সুন্দরী তরুণী নার্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেবে তা যেকোনো বাবা-মায়ের কাছে ছিল কল্পনাতীত। বাবা-মা মেয়ের সিদ্ধান্ত মেনে না নিলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান ফ্লোরেন্স।
১৮৪৪ সালে তিনি জার্মানির লুথেরান হসপিটাল অফ পাস্ত্তর ফ্লিয়েডনায় নার্সিংয়ের ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হন। ১৮৫০ সালের শুরুর দিকে তিনি লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করেন ও মিডেলসেক্স হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ শুরু করেন। কর্মক্ষেত্রে তার আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা কর্তৃপক্ষকে বিমুগ্ধ করে ও তিনি এক বছরের মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।
তৎকালীন সময়ে যখন কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ও অপরিচ্ছন্নতার কারণে এই সংক্রামক ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তখন নাইটিঙ্গেল হাসপাতালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উন্নতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কমাতে সাহায্য করেন।
আরও পড়ুন: গরমে চোখের যত রোগ
ক্রিমিয়ান যুদ্ধে নার্স হিসেবে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের যে অভিজ্ঞতা সেটিই স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে তার মধ্যে আধুনিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ লাভ করতে সাহায্য করেছে। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে ভিক্টোরিয়ান সংস্কৃতির আইকন হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি যে সংস্কার সাধন করেছেন তাতে প্রভাবিত হয়ে পুরো বিশ্বে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে।
ক্রিমিয়ান যুদ্ধে আহত সৈন্যদের সেবার মাধ্যমে নার্সিংকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। হ্যারিকেন নিয়ে রাতের আঁধারে তিনি ছুটেন আহতদের দ্বারে দ্বারে। এরপর থেকেই বিশ্ব তাকে ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ ডাকতে শুরু করে। যুদ্ধের পর ফ্লোরেন্স বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশারূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’। ‘নোটস অন নার্সিং’ নামে একটি বইও লেখেন।
আরও পড়ুন: খাবার খেয়ে অ্যালার্জির সমস্যায় ভুগলে করণীয়
মানুষের সেবায় তার দৃষ্টান্তমূলক অবদানের জন্য ১৮৮৩ সালে রানি ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ সম্মানে সম্মানিত করেন। ১৯০৭ সালে প্রথম নারী হিসেবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ সম্মানে সম্মানিত হন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। ১৯০৮ সালে পান লন্ডনের ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধিও। ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বহু মনীষী ফ্লোরেন্সকে ঈশ্বরের দূত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাই যারা এ পেশায় নতুন আসেন তাদের সবাই ‘নাইটিঙ্গেল প্লেজ’ নামে একটি শপথ গ্রহণ করে তার প্রতি সম্মান জানান। তার সম্মানেই ১৯৭৪ সাল থেকে ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’।