প্রাণী নিধনের মঞ্চ যেন গাজীপুরের সাফারি পার্ক, শেষ জিরাফটিরও মৃত্যু

৩ সপ্তাহ আগে
গাজীপুর সাফারি পার্কের ভিতরে অসুস্থ হয়ে আরও একটি জিরাফের মৃত্যু হয়েছে। পার্ক কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, জিরাফটি টিবি রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, তার চিকিৎসাও চলছিল। গত ২৩ অক্টোবর জিরাফটির মৃত্যু হয়।

এদিকে, জিরাফটি ছিল পার্কের সর্বশেষ জিরাফ। ফলে জিরাফটির মৃত্যুর মধ্যদিয়ে সাফারি পার্কটি জিরাফ শুন্য হয়ে গেল। এর আগে ২০২২ সালে শেষ ক্যাঙ্গারুটি মারা যাওয়ার পর থেকে ক্যাঙ্গারু বেষ্টনি শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। পার্কের লেমুর বেষ্টনীটি ফাঁকা পড়ে আছে।

 

জিরাফ মৃত্যুর ঘটনায় গত শুক্রবার শ্রীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করার পর শনিবার (২৫ অক্টোবর) জিরাফ মৃত্যুর তথ্যটি প্রকাশ হয়।  শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহম্মদ আব্দুল বারিক জিডির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

জিডিটি করেছেন পার্কের বন্যপ্রানী পরিদর্শক রাজু আহমেদ (৩৬)। জিডিতে বলা হয়েছে, গাজীপুর সাফারি পার্কে আফ্রিকান সাফারীতে একটি পূর্ণ বয়স্ক অসুস্থ স্ত্রী জিবাফ চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৩ অক্টোবর বিকাল ৪টায় মারা যায়। গাজীপুর সাফারী পার্কের বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. মো. গোলাম হায়দার, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাতেম সাজ্জাত ম. জুলকার নাইন, গাজীপুর সাফারী পার্কের ভেটেরিনারি কর্মকর্তা সরেজমিনে উপস্থিত হয়ে মৃত জিরাফটির পোস্ট মার্টেম সম্পন্ন করেন। তাদের প্রতিবেদনে জানান, জিরাফটি টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে মাথা যায়। সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে সাধারণ ডায়েরি দায়ের করতে কিছুটা বিলম্ব হয়।

 

আরও পড়ুন: রাজশাহীর ২ জলাভূমিকে ‘প্রাণী অভয়ারণ্য’ ঘোষণা

 

এ বিষয়ে গাজীপুর সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারেক রহমান জানান, দীর্ঘদিন ধরে সাফারি পার্কের সব শেষ জিরাফটি টিবি আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ ছিল। জিরাফটিকে সুস্থ করতে ছয় সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। মেডিকেল বোর্ডের সবশেষ চেষ্টা ব্যর্থ করে গত ২৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার পার্কের ভেতরেই মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর জিরাফটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। পরে পার্কের ভেতরেই জিরাফটিকে মাটি চাপা দেয়া হয়।

 

একটি গৌরবময় সূচনা, করুণ পরিণতির পথে:

 

থাইল্যান্ডের 'সাফারি ওয়ার্ল্ড' ও ইন্দোনেশিয়ার 'বালি সাফারি পার্ক'-এর আদলে ২০১৩ সালে গাজীপুরের সদর ও শ্রীপুর উপজেলার বাঘের বাজার এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে প্রায় ৩ হাজার ৬৯০ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় গাজীপুর সাফারি পার্ক। কয়েক হাজার কোটি টাকায় পার্ক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল, প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ, জনসচেতনতা সৃষ্টি, ও পর্যটনের বিকাশ।

 

পার্ক সূত্রে জানা গেছে,  শুরুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হয়েছিল বাঘ, সিংহ, জিরাফ, জেব্রা, ক্যাঙ্গারু, লেমুর, ম্যাকাও, প্যারট, ধনেশ, কাকাতুয়াসহ বহু বিরল প্রজাতির প্রাণী ও পাখি।  দর্শনার্থীরা নিরাপদ গাড়িতে করে ঘুরে প্রাণীদের উন্মুক্ত বিচরণ উপভোগ করতেন। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে জঙ্গলের প্রাণীদের দেখতে পেতেন কাছ থেকে। দেশের অন্যতম বৃহৎ পার্কটি একসময় ছিল দর্শনার্থীদের বিস্ময় আর আনন্দের আধার এবং জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্র।  নানা রকমের বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ, উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ, আর দৃষ্টিনন্দন বিন্যাসে এটি হয়ে উঠেছিল দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় ভ্রমণ গন্তব্য।

 

তবে সময় গড়াতেই দৃশ্যপট বদলে যায়। এক যুগের মধ্যেই পার্কটি পরিণত হয় এক দুর্নীতিগ্রস্ত, অব্যবস্থাপনায় ভরা, প্রাণী নিধনের মঞ্চে। প্রাণীর অস্বাভাবিক মৃত্যু, বন্যপ্রাণী চুরি, প্রাণীর পালিয়ে যাওয়া, খাবার ও চিকিৎসায় অনিয়ম, গাছ পাচার থেকে শুরু করে অবৈধ নিয়োগ ও রাজস্ব ফাঁকি-সব মিলিয়ে ধুঁকছে গাজীপুর সাফারি পার্ক। এতে শুধু বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা নয়, পর্যটকদের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ছে।

 

প্রাণী মৃত্যুর মিছিল-জবাবদিহির কোনো বালাই নেই:

 

সাফারি পার্কে প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা এখন খুব স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এসব মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে, প্রাণী মৃত্যুর জন্য পার্ক কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতিকে দায়ি করা হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।


২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বরে একটি সিংহ ও ওয়াইল্ডবিস্ট মারা যাওয়ার পর থেকে শুরু হয় প্রাণী মৃত্যুর ধারাবাহিক মিছিল। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে মারা যায় ১১টি জেব্রা, একটি সিংহ ও একটি বাঘ। ২০২২ সালে শেষ ক্যাঙ্গারুটি মারা যাওয়ার পর থেকে ক্যাঙ্গারু বেষ্টনি শূন্য হয়ে পড়ে।

 

২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে একটি আফ্রিকান মাদী লেমুরের মৃত্যু হয়। তখন পার্কে মোট চারটি আফ্রিকান লেমুর ছিল। তখন দাবি করা হয়েছিল, হৃদরোগে (হার্ট অ্যাটাকে) আক্রান্ত হয়ে লেমুরটি মারা গেছে। পরে বিকেলে মৃত লেমুরটির ময়নাতদন্ত শেষে মাটিচাপা দেয়া হয়।

 

পরে একটি নীলগাই পার্ক থেকে নিরুদ্দেশ হয়, এর হদিস মেলেনি আজও। এসব ঘটনায় শুধু তদন্ত কমিটি করেই দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ।

 

২০২৩ সালের অক্টোবরে মারা যায় একটি জিরাফ। বর্তমানে পার্কে কোনো পুরুষ জিরাফ না থাকায় প্রজনন কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে গেছে। লেকগুলো একসময় হোয়াইট ও ব্ল্যাক সোয়ানে ভরপুর থাকলেও বর্তমানে সেগুলোও নিস্তব্ধ।


প্রাণী চুরি ও পাচার:

প্রাণী মৃত্যুর পাশাপাশি চলছে পার্কের পশু-পাখি চুরি ও পাচারের মত ঘটনা। ২০২৪ সালের ২২ মার্চ দিবাগত রাতে পার্কে থাকা তিনটি আফ্রিকান লেমুর চুরি হয়ে যায়। এদের মধ্যে দুটি ছিল শাবক ও একটি প্রাপ্ত বয়স্ক। চুরির ঘটনায় শ্রীপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। তবে এখনও চুরি যাওয়া প্রাণী উদ্ধার বা জড়িত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। এখন পার্কে লেমুর বেষ্টনীটি ফাঁকা পড়ে আছে।


২০২৩ সালের ২২ নভেম্বরে পার্ক কর্মচারীদের সহায়তায় পার্ক থেকে দুটি ম্যাকাও পাখি চুরি হয়।  পরে থানায় মামলা হলে অভিযান চালিয়ে একটি ম্যাকাও উদ্ধার করা হলেও আরেকটির হদিস মেলেনি। এ ঘটনায় পার্কের রাসেল নামের এক কর্মচারীকে বদলি করে দায় সারে কর্তৃপক্ষ। তবে, চক্রটি বহাল তবিয়তেই রয়েছে বলে মনে করা হয়।

চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারিতে একটি নীলগাই উধাও হয়ে যায়। এখনও তার কোনো খোঁজ নেই। এত প্রাণী চুরি ও হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় বন বিভাগের অসৎ কর্মচারীর জড়িত থাকার বিষয়টি সন্দেহ করা হলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।


এসব ঘটনায় ব্যাপক সমোলোচনার মুখে গত ৯ এপ্রিল গাজীপুর সাফারি পার্ক পরিদর্শন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, গাজীপুর সাফারি পার্কের দুর্লভ প্রাণী হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় যারা দায়ী, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। শুধুমাত্র চাকরিচ্যুতি নয়, এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের গাফিলতি করার সাহস না পায়।

 

উপদেষ্টা আরো জানান, পার্ক ঘুরে তার মনে হয়েছে, কিছু প্রাণী প্রাকৃতিক পরিবেশের অনুরূপ পরিবেশে থাকলেও অনেক প্রাণীর জীবনমান পর্যাপ্ত নয়। কিছু হাতি ও জাগুয়ারের আচরণগত অস্বাভাবিকতা তাকে উদ্বিগ্ন করেছে। এই পার্ক দর্শনার্থীদের জন্য শুধু বিনোদনের নয় বরং প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতা শেখার স্থান হওয়া উচিত।

 

আরও পড়ুন: ঠেকানো যাচ্ছে না বন্যপ্রাণী পাচার ও হরিণ শিকার!


এসব বিষয়ে শনিবার বিকালে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে প্রশ্ন করা হয়, ‘গাজীপুর সাফারি পার্কের শেষ জিরাফটিও মারা গেল। এখন সাফারি পার্ক জিরাফ শুন্য। আপনি সাফারি পার্ক ভিজিট করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছিলেন। তদন্ত কমিটি হয়েছিল, শুনেছি তারা রিপোর্ট জমা দিয়েছে কিন্তু কিছুই হলো না। জবাবদিহি তার অভাবে সাফারি পার্টি আজ ধ্বংস হওয়ার পথে’


তিনি প্রতি উত্তরে জানান, কিসের কিছু হয় নাই? ঐ তদন্তের সাথে এটার সম্পর্ক নাই। এই জিরাফটার টিবি ছিলো, আইসোলেসনে রেখে চিকিৎসা করা হয়েছিল।
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন