কাশ্যপের ক্যারিয়ারে এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। আর ওমানের ক্রিকেট ইতিহাসে এটি তৃতীয় বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ। তবে বিশ্বকাপ আসরে অংশগ্রহণকে ঘিরে খেলোয়াড়দের মধ্যে যে তুমুল উন্মাদনা ছিল গত বছর, এক বছরের ব্যবধানে সেটি রূপ নিয়েছিল বিরক্তি এবং হতাশায়। কারণ বিশ্বকাপ শেষের এক বছর পরেও প্রাইজমানির কোনো অর্থ হাতে পাননি ক্রিকেটাররা।
বিশ্বকাপের প্রাইজমানির কোনো অর্থ না পেয়ে বোর্ডের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্কের শুরু হয় ওমান ক্রিকেটারদের। আর সেই তিক্ততার জেরে দল ছেড়েছেন তখনকার প্রায় সব ক্রিকেটার। অনেকে তো দেশ ছেড়ে অন্য দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছেন। তাদেরই একজন কাশ্যপ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন এই ক্রিকেটার। সেখানকার ক্রিকেটে নাম লেখিয়ে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করছেন তিনি।
ক্রিকেটভিত্তিক ওয়েবসাইট ইএসপিএনক্রিকইনফোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'এই ইস্যুতে আমাদের জীবনই ওলট-পালট হয়ে গেছে। আমরা দল থেকে বাদ পড়েছি, আমাদের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে এবং আমাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এটা খুবই অসহ্যকর। আমরা বুঝতে পারছি না আইসিসি কেন আমাদের প্রাপ্য অর্থ বুঝিয়ে দিতে পারছে না এবং কেন আমাদের উদ্বেগ প্রকাশের জন্য নিরাপদ কোনো জায়গা নেই?'
২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টটির ইতিহাসের রেকর্ড প্রাইজমানি দেয়া হয়েছে। আইসিসির দেয়া তথ্যানুযায়ী, টুর্নামেন্টের মোট পুরস্কারের অর্থ ছিল ১১.২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ওমানের প্রাপ্য ছিল সোয়া দুই লাখ মার্কিন ডলার। তবে ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউসিএ) জানায়, একাধিক অংশগ্রহণকারী বোর্ডই তাদের খেলোয়াড়দের পুরো পুরস্কারের অর্থ দেয়নি। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ওমানের বিরুদ্ধে। কারণ তারা খেলোয়াড়দের এক টাকাও দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে ক্রিকনফোকে প্রজাপতি বলেন, 'আইসিসির ইভেন্টে অংশগ্রহণের শর্ত অনুযায়ী, সদস্য বোর্ডগুলো টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার ২১ দিনের মধ্যে খেলোয়াড়দের পুরস্কারের অর্থ দিতে বাধ্য। আইসিসি নিশ্চিত করেছে যে তারা ওমান ক্রিকেটকে অর্থ প্রদান করেছে, কিন্তু সেই অর্থ খেলোয়াড়দের কাছে পৌঁছায়নি।'
শুধু এটিই নয়, ওমান ক্রিকেটারদের অভিযোগ বোর্ডের স্বচ্ছতা নিয়েও। কাশ্যপ জানান, পুরস্কারের অর্থ নিয়ে মিডিয়ার প্রচার না থাকলে ক্রিকেটাররা জানতেই পারতেন না যে এই অর্থের প্রাপক তারা। তিনি এটাও জানান, ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পুরস্কারের অর্থও তারা পাননি। কারণ তারা এটি সম্পর্কে অবগত ছিল না।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের তিন মাস পর সেপ্টেম্বরে কানাডায় একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ (কানাডা ও নেপালের বিপক্ষে) খেলতে গিয়ে ওমানের ক্রিকেটাররা প্রথমবার এই ইস্যু তুলেছিল। তাও কানাডা এবং নেপালের ক্রিকেটারদের কল্যাণে। কারণে ওখানে গিয়ে ওই দুই দলের ক্রিকেটাররা কাশ্যপদের জানায় যে তারা তাদের অংশ বোর্ডের কাছ থেকে পেয়েছে।
ডব্লিউসিএ’র দাবি, অন্যান্য সহযোগী দেশের খেলোয়াড়রা তাদের বোর্ডের কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থের পুরোটা না পেলেও ২০-৭০ শতাংশ পেয়েছে। কিন্তু ওমানের খেলোয়াড়রা টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলেও তাদের খেলায় মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
অক্টোবরে ওমানে অনুষ্ঠিত ইমার্জিং এশিয়া কাপের আগে খেলোয়াড়রা আবারও এই ইস্যু তোলেন। এবার তারা একত্রে পদক্ষেপ নিয়ে খেলা ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এতে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে।
টুর্নামেন্টের আগে অনুশীলনের সময় একজন বোর্ড কর্মকর্তা খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং পৃথকভাবে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করেন, তারা খেলতে চান কিনা। খেলোয়াড়রা পুরস্কারের অর্থ না পাওয়া পর্যন্ত খেলতে অস্বীকার করলে তাদের দল থেকে বাদ দেয়ার হুমকি দেয়া হয়।
তবে খেলোয়াড়দের কড়া সিদ্ধান্তে নরম না হয়ে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় ওমানের বোর্ড। তারা সিনিয়র ক্রিকেটারদের জানায়, হয় খেলো, নয়তো বোর্ড কাছে আরও ১৫ জন খেলোয়াড় প্রস্তুত রয়েছে। খেলোয়াড়রা অস্বীকার করলে তাদের হোটেল থেকে বের হয়ে যেতে বলা হয়।
ইমার্জিং এশিয়া কাপে ওমানের দল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ঘোষিত ১৫ জনের মাত্র পাঁচ জন খেলেছিলেন। আগের ম্যাচের একাদশ থেকে মাত্র ৪ জন এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল থেকে মাত্র দুজন ছিলেন এই ম্যাচে।
আরও পড়ুন: তদন্ত কমিটির রিপোর্টে ওঠা অভিযোগের প্রেক্ষিতে তামিমের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
শুধু দল থেকেই যে বাদ পড়েছেন ক্রিকেটাররা এমন নয়। এই ঘটনার পর অনেক ক্রিকেটারদের ওমান ছাড়তেও বাধ্য করা হয়। অনেক ক্রিকেটারের ভিসা ও চাকরি বাতিল করা হয়, যার ফলে তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
ক্ষতিগ্রস্ত ক্রিকেটারদের একজন ছিলেন ফাইয়াজ বাট। ওমানের হয়ে ৩০টি ওয়ানডে এবং ৪৭টি টি-টোয়েন্টি খেলা এই ক্রিকেটার ক্রিকইনফোকে বলেন, 'এটা আমার ক্যারিয়ার ও পেশাগত জীবনে বিশাল ক্ষতি। আমাকে ওমান ছাড়তে হয়েছে। আমি এখন বেকার, সুযোগ খুঁজছি। কিন্তু আমাদের খেলোয়াড়ি জীবন শেষ।'
ওমানে ক্রিকেটারদের কোনো সংগঠন নেই। ডব্লিউসিএ'র সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাদের সাহায্য করেছেন কানাডা ও নেপালের ক্রিকেটাররা। ডব্লিউসিএ জানিয়েছে, সহযোগী সদস্য দেশের খেলোয়াড়দের পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব এসব সমস্যার অন্যতম কারণ। তাদের মতে, বোর্ডগুলো জানে যে খেলোয়াড়রা এসব প্রাপ্য অর্থ সম্পর্কে উদাসীন। তাই তারা সেই সুবিধাটা নেয়। এছাড়া খেলোয়াড়রা জেনে গেলেও ভয় দেখিয়ে তাদের দাবি আটকে দেয় তারা।
ডব্লিউসিএ’র সিইও টম মোফাট এ প্রসঙ্গে বলেন, 'ক্রিকেটার ধরে রাখা এবং খেলার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য এই ধরনের সমস্যা হতাশাজনক। আইসিসি বোর্ডগুলোকে এই বিষয়ে তাগিদ দিচ্ছে। এটি খেলার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।'
আইসিসি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকলেও কড়া কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ডব্লিউসিএ প্রস্তাব রেখেছিল, সদস্যদের বণ্টনকৃত অর্থ থেকে খেলোয়াড়দের বকেয়া টাকা কেটে রাখার জন্য। তবে আইসিসির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সেটা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।