পম্পেইর ধ্বংস থেকে সিলেটের পাথর: পৃথিবীর পেটের ভেতর জ্বলছে ভয়াবহ আগুন!

৪ সপ্তাহ আগে
ভাবুন তো একটা জাঁকজমকপূর্ণ শহর, চোখের সামনেই নিমিষের মধ্যে আগুনে পুড়ে ভঃস্ব হয়ে গেলো। এটা কি অসম্ভব কিছু? না।

আপনারা অনেকেই পম্পেই নগরী কথা শুনেছেন, যেটা ৭৯ খ্রিস্টাব্দের এক সকালে হঠাৎ মাউন্ট ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়ার কারণে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, ৬০ ফুট উঁচু ছাই আর আগুনে গলিত পাথরের নিচে চাপা পড়ে যায়। যার ফলে হাজার হাজার মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে যায়, ধ্বংস হয়ে যায় পুরো শহর।

 

তারপর, কালের পরিক্রমায় পম্পেই এখন ইতিহাস। আর পৃথিবী পেয়ে যায় ভূতত্ত্বের সবচেয়ে বড় সাক্ষ্যগুলোর একটি- আমাদের পায়ের নিচের এই পৃথিবী, যার ভেতরে জ্বলছে ভয়াবহ আগুন!

 

আজকে জানবো, পৃথিবীর এই রহস্যময় আগুন সম্পর্কে। জানবো আগ্নেয়গিরি আর শিলার গঠন ও তাদের রুপান্তরের গল্প।

 

পৃথিবীর গঠন:

আমরা যে মাটিতে হাঁটি, তার অনেক নিচে আছে এক ভীষণ শক্তিশালী গলিত জগত। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ বা crust এর নিচে আছে ম্যান্টল, যেখানে শিলা থাকে তরল বা অর্ধ-তরল অবস্থায়, যাকে বলে ম্যাগমা বা গলিত শিলা।

পৃথিবী একটানা কাজ করছে, নতুন শিলা তৈরি হচ্ছে, পুরোনোটা গলছে, আবার সেই গলিত শিলা ঠান্ডা হয়ে নতুন রূপ নিচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

 

এই ম্যাগমা যখন চাপ পায়, তখন সে পথ খোঁজে বেরিয়ে আসার। আর যখন বেরিয়ে আসে, তখনই সৃষ্টি হয় আগ্নেয়গিরি। যখন পৃথিবী নিজের ভিতরের আগুন উগরে দেয়, তখন তার পরিণাম হয় ভয়াবহ, কিন্তু সেই ধ্বংসের মধ্যেই জন্ম নেয় নতুন সৃষ্টি। এই আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ শুধু ধ্বংসই আনে না, বরং পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন শিলা বা পাথরের জন্ম দেয়।

 

আরও পড়ুন: এলিয়েন বলতে কিছু আছে পৃথিবীতে? কোরআন হাদিস কী বলে?

 

শিলার জন্ম:

 

পৃথিবীর পাথর শুধু পাথর না, ওরা আসলে সময়, আগুন আর চাপে গড়া ইতিহাস। প্রতিটি শিলা বলে একেকটা কাহিনি: কোথায় জন্মেছে, কেমনভাবে বদলেছে, আর কত যুগ পার করেছে।

 

আগ্নেয় শিলা (Igneous Rock):

যখন ম্যাগমা ঠান্ডা হয়ে জমে যায়, তখন তৈরি হয় আগ্নেয় শিলা। যেমন ব্যাসাল্ট, গ্রানাইট। এগুলোই পৃথিবীর মূল ভিত্তি তৈরি করেছে। আমরা যে পাহাড় বা গিরিখাত দেখি, যার অনেকগুলোই এই আগ্নেয় শিলা দিয়ে গঠিত।

 

পাললিক শিলা (Sedimentary Rock):

নদী, বাতাস বা হিমবাহ যে মাটি-বালি বহন করে আনে সেগুলো জমে জমে, স্তর তৈরি করে ধীরে ধীরে হয়ে যায় পাললিক শিলা। যেমন চুনাপাথর, বেলেপাথর, শেল। এগুলোর ভেতরেই থাকে জীবাশ্ম, যা আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাণীদের গল্প।

 

রূপান্তরিত শিলা (Metamorphic Rock):

যখন আগ্নেয় অথবা পাললিক কোনো শিলা চরম তাপ ও চাপে পড়ে নিজের গঠন বদলে ফেলে, তখন সে হয়ে যায় নতুন এক রূপ, যাকে বলে রূপান্তরিত শিলা। যেমন মার্বেল (চুনাপাথর থেকে), গনাইস (গ্রানাইট থেকে)।

 

শিলার ব্যবহার:

আজ আমরা যেসব পাথর দেখি বিল্ডিং, রাস্তাঘাট, সেতু বা ঘরের সৌন্দর্যে, সবই এই তিন ধরনের শিলারই ফল।

গ্রানাইট – টেকসই আর দৃষ্টিনন্দন, বিল্ডিং ও স্মৃতিসৌধে ব্যবহৃত হয়।

চুনাপাথর – সিমেন্ট তৈরির প্রধান উপাদান।

মার্বেল – সৌন্দর্য আর কারুশিল্পের প্রতীক।

বেলেপাথর – নির্মাণ, পেভিং এবং অলঙ্কারে ব্যবহৃত হয়।

 

সিলেটের সাদা পাথর রহস্য:

এবার আসি বাংলাদেশের গল্পে। সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের সাদা পাথর নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এই পাথর কোথা থেকে আসে? এটা কী ধরনের শিলা?

 

সিলেটের এই সাদা পাথর মূলত পাললিক শিলা, যা হাজার বছর ধরে নদীর পানিতে জমে, চাপ পেয়ে শক্ত হয়ে গিয়েছে। এগুলো তৈরি হয়েছে পাহাড়ি নদীর বালি, মাটি ও খনিজ কণার স্তর জমে জমে। তাদের রঙ সাদা, কারণ এতে কোয়াটজ ও চুনাপাথরের উপাদান বেশি। এই সাদা পাথর শুধু নির্মাণে নয়, দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে অযাচিত উত্তোলন ও পরিবেশের ক্ষতি হলে, এই সম্পদই পরিণত হতে পারে সংকটে।

 

জীবন্ত পৃথিবীর গল্প:

আমরা যে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আছি, তার নিচে আছে কোটি বছরের উত্তাপ, চাপ, আর রূপান্তরের গল্প। পৃথিবী একটানা কাজ করছে, নতুন শিলা তৈরি হচ্ছে, পুরোনোটা গলছে, আবার সেই গলিত শিলা ঠান্ডা হয়ে নতুন রূপ নিচ্ছে।

এ এক অবিরাম চক্র:
 

ম্যাগমা → আগ্নেয় শিলা → পাললিক → রূপান্তরিত → আবার ম্যাগমা।

 

এই চক্রই পৃথিবীকে জীবন্ত রাখছে।

 

আরও পড়ুন: দ্রুত গলছে, হারিয়ে যেতে বসেছে পৃথিবীর বৃহত্তম হিমশৈল

 

তাহলে ভাবুন তো, যে পাথরকে আমরা নিস্তব্ধ মনে করি, সে আসলে পৃথিবীর স্পন্দন! সে পৃথিবীর পরিবর্তনের গল্প বলে, অভিযোজনের গল্প বলে।


পম্পেইর মতো ধ্বংস, সিলেটের সাদা পাথরের মতো সম্পদ, সবই এক মহাপ্রক্রিয়ার ফল। যা বলে দেয়, পৃথিবী আসলে কখনো স্থির নয়, বরং প্রতিদিন নতুন হয়ে জন্ম নিচ্ছে। পৃথিবী নিঃশব্দ, কিন্তু তার ভেতর চলছে সৃষ্টির গর্জন।
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন