সম্প্রতি ৫ জুলাই ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বালু লুট বন্ধে প্রতিবাদসভা ও মানববন্ধন করলে প্রকাশ্যেই বালু লুটকারীরা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণ করে হামলা চালান। এর আগে ১৬ জানুয়ারি ও ১৯ মে দুই দফায় বালু লুটকারীরা অবৈধ বালু উত্তোলন এলাকায় অভিযানে গেলে রায়পুরা উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর হামলা চালান।
এসব ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়েছে আতংক। বালু লুটকারীদের বিরুদ্ধে কেউ-ই মুখ খুলতে চান না। প্রশাসন ও এলাকাবাসীর ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে হয়নি কোনো মামলা। এ সুযোগে ভয়াবহ বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন লুটকারীরা। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা নির্বিকার।
স্থানীয়রা জানান, বালু মহাল ইজারা হয়েছে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরাবাদ। ১৪৩২ বঙ্গাব্দ মেয়াদে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় ইজারা পেয়েছে সাহেবনগরের শাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স সামিউল ট্রেডার্স’। কিন্তু তারা দেদারসে বালু লুট করছেন রায়পুরা সীমানার শান্তিপুর এলাকা থেকে। যে এলাকায় কিছুদিন আগে স্থানীয়রা প্রতিবাদ সভা করেছিলেন, এখন আর সেই এলাকাটিরও অস্তিত্ব নেই, বিলীন হয়ে গেছে। ফসলি জমি, মসজিদ, মাদ্রাসা এবং শত শত বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে। তবুও প্রশাসন নীরব দর্শক।
আরও পড়ুন: মহাদেও নদে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে তিনজনের কারাদণ্ড
অনুসন্ধানে জানা যায়, বালু লুট কেন্দ্র করে এলাকাটি অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ছে। বালু লুটকারীরা প্রকাশ্যে অস্ত্রসহ মহড়া দিয়ে থাকেন। বালু লুটের সীমানা এলাকাজুড়ে থাকে তাদের বিশেষ পাহারা চলে দিনে-রাতে। চক্রটি স্পিডবোটযোগে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাখেন। অন্তত ১০-১৫ টি চুম্বক ড্রেজার লাগিয়ে বালু লুট করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, তাদের ছত্রছায়া দিয়ে থাকেন উপজেলা ও জেলা বিএনপির নেতাদের একাংশ। যেটি আগে ঘটতো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায়।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক অন্তত ৫ জন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘মেঘনার বালু লুটে বিএনপি-আ.লীগ ভাই ভাই। আগে যারা আ.লীগ করতেন, এখন তারা বিএনপি হয়ে গেছে। বালু লুটে জড়িত আ.লীগের অনেক নেতা এখন বিএনপি হয়ে গেছেন। আর বিএনপির নেতারা বালু লুট করতে স্থানীয় আ.লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঐকমত্য হয়েছেন।’
আরও পড়ুন: মাদারীপুরে খাঁ নদে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে মানববন্ধন
মির্জাচর যুবদলের একটি আইডির পোস্টে লিখা হয়, ‘সন্ত্রাসী নূর ইসলাম, ঈমান আলী, হারুন, হান্নানের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে মির্জারচরকে যারা ধ্বংস করেছেন, কাউকে চুল পরিমাণ ক্ষমা করা হবে না।’
স্থানীয়দের কয়েকজন বলেন, ‘মির্জাচর ইউনিয়নের যুবদলের সভাপতি প্রার্থী নূর ইসলাম, ৫ আগস্টের আগে যুবলীগের সভাপতি প্রার্থী ছিলেন ঈমান আলী, বাশগাড়ী ইউনিয়ন যুবলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি হারুন মিয়া, নীলক্ষ্যা ইউনিয়নের যুবদলের সভাপতি প্রার্থী মো. হান্নান মিয়া, চরমধুয়া ইউনিয়ন শ্রমিকলীগের সভাপতি আমানুল্লাহ, তারাই মূলতঃ বালু লুটের মূল কারিগর। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর হামলাও করেছেন তারা। এদের প্রত্যেকের নামে হত্যা,অস্ত্র, পুলিশের ওপর হামলা, লুটতরাজ মামলা রয়েছে। ৫ আগস্টের আগে তারা সবাই-ই আ.লীগের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় ছিলেন। এখন আবার তাদেরই বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে নানা প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।
অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা, জেলা বিএনপির একাংশ ও প্রভাবশালী এক কেন্দ্রীয় নেতা বালু লুটের ভাগ নিচ্ছেন। এ সংক্রান্ত বক্তব্যের রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষণ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে যুবদল নেতা মো. হান্নান মিয়া বলেন, ‘নাসিরাবাদ বালু মহাল আছে, ওইখানে শেয়ারে আছি। আরও অনেক মানুষই আছে, এটা গোপনীয় না। এলাকাটি নদীর এপাড়-ওপাড় হওয়ায় প্রতিপক্ষ নানা অভিযোগ করে থাকেন।
ফেসবুকে আপনাদের নাম উল্লেখ করেও অনেকে পোস্ট দেন এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কেউ কিছু বললে আর লিখলে ধরে বেধে রাখা যাবে না। এলাকায় গ্রুপিং থাকায় প্রতিপক্ষ নানা কিছু বলে থাকেন।’
এ বিষয়ে বিএনপির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সহ-সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ উদ্দিন বকুল বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়িত আছে অভিযোগ আছে, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নাই। তবে যারা জড়িত আছে তাদেরকে আমি বিএনপির নেতাকর্মী বলি না। তারা দলের আদর্শ ধারণ করেন না। তাদের যদি এসবই করতে হয় দল কেন করবেন? চুরি, ডাকাতি করলেই পারে। তাদের আমলনামা সব গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছেও আছে। যদি তারা ভাবেন এসব করে পার পেয়ে যাবেন, ভুল ভাবছেন। এখন হয়তো ব্যবস্থা আসছে না, কিন্তু আসবে, সঠিক সময়ে দল ব্যবস্থা নেবে।’
আরও পড়ুন: অবৈধ বালু উত্তোলনে আর মাসি-পিসির খেলা চলবে না: টিপু
রায়পুরা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান খোকন বালু লুটের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক মন্তব্যে লিখেন, ‘মির্জারচরকে রক্ষা করতে রায়পুরার সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রশাসনের নিকট মির্জারচরের মানুষের আর্তনাদ পৌঁছে না। সাংবাদিকদের কলমের কালি এই জায়গায় কাজে লাগে না।’
এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর দুই দফায় হামলার ঘটনায় কেন মামলা হয়নি। জড়িতদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি এমন প্রশ্নে রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আদিল মাহমুদ বলেন, ‘এটা ইউএনও বলতে পারবেন, তিনিই তো ভ্রাম্যমাণ আদালতের প্রধান। আমাদের কাছে পুলিশ চেয়েছে আমরা পুলিশ সদস্য দিয়েছি। মামলা করলে তারা করবেন, আমরা কেন মামলা করব?’
রায়পুরা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর হামলার বিষয়ে পুলিশকে মামলা করতে বলা হয়েছিল, পুলিশ করেনি। বালু লুটকারীদের বিষয়ে প্রশাসন অবগত আছে। শিগগিরই ম্যাসিভ (বড় আকারে) ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
নরসিংদীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নাজমুল হাসান বলেন, নরসিংদী জেলায় এই মুহূর্তে বৈধ কোনো বালু মহাল নেই। কেউ যদি বালু উত্তোলন করে থাকে অবৈধভাবে করছেন। এ বিষয়ে নিয়মিতই অভিযান পরিচালনা করা হয়। জেলার কোথাও বালু লুটের ঘটনা অবহিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।