দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে যেভাবে ইসলামের সূচনা হয়েছিল

১ সপ্তাহে আগে
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর দাপ্তরিক নাম ‘দ্য রিপাবলিক অব পেরু’। দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম ও মধ্য অঞ্চলে, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত। উত্তরে ইকুয়েডর ও কলম্বিয়া, পূর্বে ব্রাজিল, দক্ষিণ-পূর্বে বলিভিয়া, দক্ষিণে চিলি, দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর দিয়ে বেষ্টিত এই দেশ ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত।

পেরুতে রয়েছে জনবিরল মরুভূমি, সবুজ মরূদ্যান, বরফাবৃত পর্বতমালা, উচ্চ মালভূমি, দুর্গম উপত্যকা। ঘন ক্রান্তীয় অরণ্য। সমুদ্রতীরবর্তী লিমা শহর দেশটির প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও রাজধানী। ১২ লাখ ৮৫ হাজার ২১৬ বর্গমাইল আয়তনের এ দেশে মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৪৩ লাখ। এর ৯৫ শতাংশই খ্রিস্টান, মুসলমানের সংখ্যা মাত্র ১ শতাংশেরও কম।

 

ঐতিহাসিকদের মতে, পেরুতে খ্রিস্ট-পূর্ব সাড়ে ১২ হাজার বছর আগে মানববসতি গড়ে ওঠে। পেরু ছিল ইনকা সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি। মাচুপিচু, ইনকা সাম্রাজ্যের সময় গড়ে ওঠা একটি শহর, আজও পেরুর অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। খ্রিস্টীয় ১৬ শতকে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক বাহিনীর হাতে ইনকা সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ১৯ শতকের শুরুতে পেরু স্বাধীনতা লাভ করে।

 

আরও পড়ুন: ফিরে দেখা ২০২৪: হারালাম যেসব আলেমকে 

 

পেরুতে ইসলামের সূচনা

 

পেরুতে ইসলামের সূচনা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভিন্নতা আছে। অনেক ঐতিহাসিক দাবি করেন, আমেরিকা আবিষ্কারের চার শ বছর আগে আফ্রিকা ও স্পেনের মুসলিমরা লাতিন আমেরিকার সাথে পরিচিত ছিলেন। ধারণা করা হয়, ১১০০ থেকে ১১৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মুসলিমরা আমেরিকা মহাদেশে পদার্পণ করে। মুসলিমদের দ্বারা নির্মিত কিছু স্থাপত্য নিদর্শন, আন্দালুসীয় স্থাপত্য রীতিতে গড়ে ওঠা ভবনগুলো এই দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত।

 

স্পেনীয় ঔপনিবেশিক আমলে (১৫৩২ সালের পর) আফ্রিকা থেকে দাসদের পেরুতে আনা হয়। এদের মধ্যে অনেকে মুসলমান ছিলেন। যদিও দাসপ্রথার কঠোর শর্তাবলীর কারণে মুসলিম দাসদের ধর্মচর্চা করা কঠিন হয়ে পড়ে, তবুও তারা গোপনে তাদের ধর্ম পালন করতেন। স্প্যানিশ শাসকরা ইসলামচর্চাকে কঠোরভাবে দমন করে। ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে লোপে ডে লা পেনা নামক একজন মুসলিমকে ইসলামচর্চার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার মতো আরও অনেকে একই ধরনের শাস্তি ভোগ করেন। এই কঠোর শাসনের ফলে পেরুতে ইসলাম প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

 

ইসলামের পুনর্জাগরণের সূচনা

 

ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটে ১৯ শতকের শেষ ভাগে এবং ২০ শতকের শুরুর দিকে, যখন লেবানন ও প্যালেস্টাইন থেকে মুসলিম অভিবাসীরা পেরুতে আসতে শুরু করেন। তারা মূলত ব্যবসার জন্য আসলেও ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ অভিবাসীদের মধ্যে ইসলামের পুনর্জাগরণের একটি বড় ভূমিকা ছিল।

 

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে গৃহহীন হওয়া মুসলিমদের একটি দল পেরুতে আশ্রয় নেয়। ফলে দেশটিতে আবারও ইসলামের চর্চা শুরু হয়। ১৯৮০ সালে পেরুর নাগরিক লুইস কাস্ট্রো ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান, যা পেরুর মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

 

পেরুতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা

 

১৯৯৩ সালে পেরুর মুসলিমরা রাজধানী লিমার ‘জেসাস মারিয়া’ জেলায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে এটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ‘ভিলা এল সালভাদর’ জেলায় আরেকটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হলেও একই কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে পেরুতে আটটি অনুমোদিত মসজিদ এবং বেশ কয়েকটি নামাজকক্ষ রয়েছে। লিমার ‘বাবে ইসলাম’ মসজিদটি পেরুর সবচেয়ে সুন্দর মসজিদ হিসেবে পরিচিত।

 

পেরুর মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ইসলামী শিক্ষা ও শিক্ষা উপকরণের অভাব। স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষ আলেমদের অভাব এখানে ইসলামের প্রসারের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। তবে ধীরে ধীরে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাব পেরুর সমাজেও দৃশ্যমান। আন্দালুসীয় স্থাপত্যশৈলী, খাদ্যাভ্যাস এবং পোশাক এসব ক্ষেত্রে মুসলিম ঐতিহ্যের ছাপ রয়েছে।

 

আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে কম মুসলিম জনসংখ্যার ৫ দেশ

 

দাসপ্রথার সময় ইসলাম পেরুতে প্রবেশ করলেও অভিবাসন, ব্যবসা এবং সম্প্রদায়গত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এটি ধীরে ধীরে পুনর্জাগরিত হয়েছে। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পেরুতে ইসলাম একটি বিকাশমান ধর্ম হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে। মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় পরিচয় ধরে রাখতে ও ইসলাম প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। পেরুর ইতিহাসে ইসলাম আজও একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিরাজমা। স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষ আলেমের অভাব পেরুতে ইসলাম প্রসারে একটি প্রতিবন্ধক বলে মনে করা হয়। তবে শত বাধার মধ্যেও পেরুতে ইসলাম একটি বিকাশমান ধর্ম। ধীরে ধীরে এখানে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন