জয়পুরহাটের বাইগুনি কেন ‘এক কিডনির গ্রাম’

১ সপ্তাহে আগে
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামকে এখন ‘এক কিডনির গ্রাম’ ডাকা হয়। কারণ দুটি কিডনি থাকার কথা থাকলেও এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের কিডনি এখন একটা।

বাইগুনি গ্রামটির ‘এক কিডনির গ্রাম’ হয়ে ওঠার পেছনে ভয়ংকর এক গল্প রয়েছে। সেই গল্পই উঠে এসেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে। মূলত দারিদ্র্য আর দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হারিয়েছেন বাইগুনি গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ।

 

প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের চরম দারিদ্র্য এবং ভারতে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে পুঁজি করে নিরীহ গ্রামবাসীর কিডনি হরণ করছে দালাল চক্র। দালালের ফাঁদে পড়ে বাইগুনি গ্রামের যেসব লোক নিজের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গটি হারিয়েছেন তাদের একজন হলেন সফিরুদ্দিন।

 

৪৫ বছর বয়সি সফিরুদ্দিন গতবছর মাত্র সাড়ে ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে ভারতে গিয়ে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন। তার আশা ছিল, পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা আর সন্তানদের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করা।

 

কিন্তু সেই টাকা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। বাড়ির নির্মাণকাজ এখনও শেষ হয়নি। আর শরীরের এই অসহ্য ব্যথা প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয়—তার সেই সিদ্ধান্তের মূল্য কতটা চড়া ছিল।

 

আরও পড়ুন: স্ত্রীর কিডনিতে নতুন জীবন পেয়ে হেলিকপ্টারে ঘরে ফিরলেন কুদ্দুস

 

সফিরুদ্দিন এখন একটি হিমাগারে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া শরীর নিয়ে দিন পার করছেন কষ্টে। নিয়মিত কাজে অংশ নেওয়াটাও হয়ে উঠছে দুঃসাধ্য। তিনি বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রী আর সন্তানদের জন্যই সব করেছি।’

 

শুরুতে ভয় থাকলেও দালালের কথায় পরে রাজি হয়ে যান তিনি। ভিসা, ফ্লাইট, হাসপাতাল সংক্রান্ত সব কাগজপত্রই ঠিক করে দেয় তারা। মেডিকেল ভিসায় ভারতে যাওয়ার সময় পাসপোর্ট ছিল নিজেরই। 

 

কিন্তু হাসপাতালের কাগজপত্রে তাকে রোগীর আত্মীয় হিসেবে দেখানো হয়। এমনকি ভুয়া আইডি, নকল জন্মসনদ বা নোটারি সার্টিফিকেটও বানানো হয়। অথচ যাকে কিডনি দিয়েছেন, তিনি কে সেটাও জানেন না সফিরুদ্দিন।

 

ভারতের আইন অনুযায়ী, শুধুমাত্র নিকটাত্মীয়দের মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা বৈধ। তবে সরকারি অনুমোদন থাকলে অন্য কেউ দান করতেও পারেন। কিন্তু দালালরা এসব আইন পাশ কাটিয়ে ভুয়া পরিবারিক সম্পর্ক তৈরি করে, এমনকি কখনও কখনও ভুয়া ডিএনএ রিপোর্টও বানিয়ে দেয়।

 

আরও পড়ুন: কিডনি রোগের লক্ষণ

 

মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঙ্গসংগঠন ‘অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন টাস্কফোর্স’-এর সদস্য মনির মোনিরুজ্জামান জানান, ‘প্রতারণার নিয়মটা মোটামুটি একই—নাম বদল, ভুয়া নোটারি সার্টিফিকেট, আত্মীয় প্রমাণের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের জাল কপি ইত্যাদি।’

 

বাইগুনি গ্রামে প্রায় ছয় হাজার মানুষের বাস। কিন্তু গ্রামের এত বেশি মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন যে এটাকে এখন অনেকে ‘এক কিডনির গ্রাম’ বলে ডাকেন।

 

২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কালাই উপজেলার প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি ৩৫ জনের একজেই কিডনি বিক্রি করেছেন। উপজেলাটি বাংলাদেশের দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি।

 

এখানকার বেশিরভাগ কিডনি বিক্রেতাই ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সি পুরুষ, যারা নগদ অর্থের প্রলোভনে পড়েছিলেন। এক গবেষণা মতে, তাদের ৮৩ শতাংশই দারিদ্র্যকে কিডনি বিক্রির প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যরা ঋণের বোঝা, মাদকাসক্তি অথবা জুয়ার আসক্তির কথা বলেছেন।

 

আরও পড়ুন: গরুর মাংস খেতে কিডনি রোগীরা কী করবেন?

 

সফিরুদ্দিন জানান, অপারেশনের পর তার পাসপোর্ট, প্রেসক্রিপশন কিছুই ফেরত দেয়নি দালালরা। এমনকি কিডনি নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে যে ওষুধ লিখে দিয়েছিল, তাও তাকে দেয়া হয়নি। সার্জারির পর ভারতে দালালরা প্রায়ই কিডনি বিক্রেতার পাসপোর্ট ও প্রেসক্রিপশন কেড়ে নেয় যাতে কোনো প্রমাণ না থাকে না। সফিরুদ্দিনের ক্ষেত্রেও তাই করা হয়।

 

বাংলাদেশ বা ভারতে কিডনি মূলত বিক্রি হয় ধনী রোগীদের কাছে, যারা বৈধ প্রক্রিয়ায় কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় থাকতে চান না। ভারতে ২০২৩ সালে মাত্র ১৩ হাজার ৬০০টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। যেখানে প্রতি বছর গুরুতর কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ২ লাখ।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন