জঈফ হাদিস কী আমল যোগ্য?

২ সপ্তাহ আগে
হাদিস শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা হচ্ছে 'জঈফ হাদিস'। বিশেষ করে উলুমুল হাদিসের পরিভাষা। বাংলাদেশে যারা উলুমুল হাদিস চর্চা করেন, সেটা হতে পারে একাডেমিক কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কোনো একজন বিজ্ঞ আলেমের অধীনে; তারা এ জাতীয় শাস্ত্রীয় পরিভাষার সঠিক প্রয়োগ সম্পর্কে অবগত আছেন।

এ ছাড়া বাকি অনেক এমন আলেম আছেন ও সাধারণ মানুষ রয়েছেন, যারা এই শাস্ত্রের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে না জানার ফলে; প্রায়ই গুলিয়ে ফেলছেন গুরত্বপূর্ণ অনেক বিষয়। যেগুলো শাস্ত্রজ্ঞ আলেমদের মতে স্বীকৃত ও সমাদৃত। এজন্য উলুমুল হাদিসে যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন কর হয়নি। 

 

বিজ্ঞ কোনো হাদিস বিশারদের ইলমি সান্নিধ্যে  সময় ব্যয় করারও সুযোগ হয়নি। তারাই অনেক বেশি বিভ্রান্ত বা প্রতারিত হচ্ছেন। অনেক সময় অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করছেন অজ্ঞাতসারে, কিংবা তারা নিজেরাই মূল বিষয়গুলো যথাযথভাবে না জানা ও না বুঝতে পারার কারণে। উদাহরণত, কেউ তাফসির বা শুধু হাদিস বিষয়ে বিশেষত্ত্ব অর্জন করার সুযোগ লাভ করেছেন। তবে এর বাইরে ফিকহের চর্চা করার সুযোগ হয়নি। তো এমন আলেম বা ব্যক্তি থেকে হাদিসের সঠিক মর্ম বোঝা কঠিন। 

 

একই বিষয়ে বর্ণিত একাধিক হাদিসের ক্ষেত্রে তারা নিশ্চিত ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। কিংবা ভুল মতের ওপর আমল করার দাওয়াত দিচ্ছেন। যা হয়ত আমলের উপযোগী নয়। কিংবা উম্মাহর আমল যুগ যুগ ধরে অন্য কোনো বর্ণনা মতো চলে আসছে। এভাবেই ভুল বোঝাবুঝি তৈরি। ভিন্ন সঠিক মতাবলম্বী কোনো একজন ফকিহের বিরুদ্ধেও বলা  হচ্ছে। এজন্য শাস্ত্রীয় আলোচনা ও বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা উচিত।

 

আরও পড়ুন: এবার নষ্ট মোবাইল দান করার সুযোগ আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনে

 

আজকের নিবন্ধে আমরা জঈফ হাদিস কী ও কেন? এটি কী আমল যোগ্য এবং এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আলেমগণ কী মতামত প্রদান করেছেন ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ! শাস্ত্রীয় আলোচনা পরিহার করে, শুধু সহজভাবে ধারণা দেওয়ার প্রয়াস থাকবে। সচেতন এবং আগ্রহী পাঠকের প্রতি আহবান থাকবে, শাস্ত্রজ্ঞ বিজ্ঞ কোনো একজন আলেম থেকে এ বিষয়ে হাতে কলমে শিখতে প্রয়াস পাবেন ইনশাআল্লাহ। যা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ঐতিহ্য এবং  ইলম অর্জন করার অন্যতম ও স্বীকৃতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।

 

প্রথমে আমাদেরকে জানতে হবে যে, 'জঈফ হাদিস' বলতে কী বোঝানো হয়? আরবি অভিধানে জঈফ শব্দের অর্থ হলো, দুর্বল অক্ষম অপারগ প্রভৃতি। অর্থাৎ, শাব্দিক অর্থে 'দুর্বল হাদিস'। কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এমন কোনো কথা বা হাদিস কখনোই দুর্বল হতে পারে না। এমন কল্পনা করাই অন্যায়।

 

বরং নবীজির বর্ণিত প্রত্যেকটি কথা, আদেশ নিষেধ এবং মৌন সমর্থন কিংবা নীরবতাই হচ্ছে হাদিস। সুরা নজমের ৪নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি যা বলেন, তা (আল্লাহ তায়ালা স্বীকৃত) ওহিতুল্য। যার মধ্যে ব্যক্তিগত কিছু বিষয় এবং বিশেষ কিছু আমল ছাড়া সুন্নাহর বাকি বিষয়গুলো আমাদের জন্য আমল যোগ্য। অনুসরণীয়। অবশ্য পালনীয় বিষয় হলে, পালনীয়। বর্জনীয় হলে, পরিহার যোগ্য। তথা আমলের উপযোগী নয়।


আবার সাহাবিগণ এমন কোনো আমল করেছেন, যে বিষয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ বা বারণ করেননি। এমনকি সাহাবিদের আমল ও বক্তব্যগুলোও হাদিস। অতএব, নির্ভর যোগ্য সূত্রে বর্ণিত সাহাবিদের বর্ণনাগুলোও হাদিস। এ জাতীয় বর্ণনাগুলো যখন এমন ব্যক্তির মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে, যিনি কোনো কারণে সমালোচিত। এমন বর্ণনাগুলো সম্পর্কে হাদিস বিশারদ ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ আপত্তি করেছেন। ক্ষেত্রবিশেষ হাদিস গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছেন। 

 

কখনো কঠিন সমালোচনা করেছেন। রচিত হয়েছে ইলমে জরহ ও তাদিল, আসামাউর রিজাল প্রভৃতি। এজন্যই বিজ্ঞ হাদিসবিশারদগণ বর্ণনাকারী রাবিদের বাহ্যিক অবস্থা, আমল আখলাক তাকওয়া এবং মুখস্থশক্তি ও বর্ণনার অবস্থা ও ভঙ্গি ইত্যাদি বিবেচনায় এক একটি বর্ণনাকে এক একটি অভিধায় উল্লেখ করেছেন। বরং সর্বোচ্চ সঠিক পন্থা অনুসরণ করা হয়েছে। বর্ণনাকারীগণও সঠিক আকিদা বিশ্বাসের অনুসারী ছিলেন। এমন শর্তে কোনো বর্ণনাকে সহি বা বিশুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়েছে। যাকে বলা হয়েছে, 'সহি হাদিস'।  

 

আর যদি কখনও কোনো বর্ণনাকারী কর্তৃক কোনো ধরনের ভুল ত্রুটি, আমলি পদস্খলন কিংবা স্মৃতিভ্রম বা এ জাতীয় আচরণ প্রকাশ পেয়েছে। তখনই হাদিস বিশারদগণ তাকে 'জঈফ হাদিস' বা বর্ণনাটি শক্তিশালী নয়, বলে মত প্রকাশ করেছেন। কাজেই যুগে যুগে উম্মাহর দীন ঈমান আমল আখলাক নামক প্রভৃতি মহা দৌলত হেফাজতকারী অতন্দ্র প্রহরী আলেমগণ এ জাতীয় হাদিসের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো মাসআলার সমাধান গ্রহণ করেননি। অথেনটিক সোর্স হিসাবে গৃহিত হয়নি এ জাতীয় বহু বর্ণনা। এগুলোর বহু শ্রেণি ও প্রকার রয়েছে। যা উলুমুল হাদিসের শিক্ষার্থী, পাঠক ও গবেষক মাত্রই অজানা নয়। 


অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে মসজিদ মাদরাসায় মিম্বারে মাহফিলে দীর্ঘ আলোচনাও হওয়া উচিত। বরং আলোচনা হওয়া এখন জরুরি মনে করি!

 

ইমাম আহমদ রহ. ও আবু দাউদ রহ. মতে কোনো হাদিস যদি মারাত্মক ধরনের জঈফ না হয়, তবে তার ওপর আমল করতে বাধা নেই। ইমাম ইবনে বায রহ. বলেছেন,  উত্তম সনদে বর্ণিত হয়েছে এমন বর্ণনা আমল যোগ্য। একইভাবে ইমাম নববি রহ. বলেন, ফুকাহায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিসগণ সহ অন্যরাও ফাজায়েলে আমল- আমলের ফজিলত, আমলের প্রতি উৎসাহদায়ক তারগীব তারহীব প্রভৃতি বর্ণনার ক্ষেত্রে জঈফ হাদিসের বর্ণনাকে আমল যোগ্য বলেছেন। যতক্ষণ না তা স্পষ্ট মওজু বা 'বানানো হাদিস' না হয়! এক্ষেত্রেও কিছু শর্ত আরোপ করেছেন পূর্ববর্তী স্কলারগণ। যেমন, বর্ণনাটি কুরআন সুন্নাহর বিপরীত না হওয়া, মারাত্মক ধরনের জঈফ না হওয়া, বর্ণনাকারী রাবি মিথ্যুক বা মিথ্যার অভিযোগে দোষী না হওয়া ইত্যাদি।

 

ফজিলতের ক্ষেত্রে আমল যোগ্য হওয়ার একটি উদাহরণ উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি। তা হলো, মাগরিবের ফরজ নামাজের পর, সুন্নাত আদায় করা শেষ হলে; নফল আউয়াবিন নামাজ আদায় করা। এটি বুখারির বর্ণনায় এসেছে, হুজাইফা রা. বলেন- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, মাগরিবের নামাজ আদায় করে এশা পর্যন্ত নফল আদায় করেছেন। অনুরূপ ইমাম তিরমিযি রহ. একটি বর্ণনা রয়েছে, যাতে ছয় রাকাত নামাজ আদায় করার ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।  এখন তিরমিযির বর্ণনাটিকে বাতিল বা বিদআত প্রমাণিত করা হলে, ইমাম বুখারি রহ. বর্ণিত হাদিসের কী হবে?

 

এজন্যই এ জাতীয় মাসআলা, যা এই সামান্য নিবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। এমন বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আমল যোগ্য এবং উম্মাহর আমল চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এমন আমলের বিরুদ্ধে বিদআত বা জঈফ হাদিস বলে মতামত তুলে ধরা, মুসলমানদেরকে আমল বিহীন অলসতা বা উদাসীনতায় উদ্বুদ্ধ করতে সহায়তা করাও সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এজন্য কোনো হাদিস সম্পর্কে মন্তব্য করতে এবং আমলকে বাতিল বিদআত প্রমাণিত করতে হলে আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। প্রচুর অধ্যয়ন করতে হবে। এমনকি শাস্ত্রীয় আলোচনাগুলোও অনুধাবন করা জরুরি।

 

লেখক: খতিব, ভবানীপুর মাইজপাড়া হক্কানি জামে মসজিদ, গাজীপুর

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন