গাইবান্ধার যেখানে এলে পূরণ হয় ‘মনের ইচ্ছে’!

৩ সপ্তাহ আগে
প্রতি বছরের মতো বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে গাইবান্ধা সদর উপজেলার দারিয়াপুরের মীরের বাগানের ইচ্ছা বা মানত পূরণের মেলা। প্রতি বছর গোটা বৈশাখ মাসজুড়েই চলে এই মেলা। এবারও বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন মেলা প্রাঙ্গণে।

মীরের বাগানে ইচ্ছা পূরণের মেলার তিন অলির মাজার প্রাঙ্গণে মানত বা ইচ্ছা পূরণের আশায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভক্ত নারী-পুরুষের পদচারণায় এখন সরগরম মেলা প্রাঙ্গণ। মনের ইচ্ছা পূরণ করতে মাজারে তবারক দেয়ার প্রস্তুতিতে ভক্তদের ব্যস্ততা গোটা মেলা জুড়ে। মানতের খিচুড়ি রাঁধতে ব্যস্ত সবাই।


ভক্তদের বিশ্বাস, মানতে অসুখ-বিসুখ কিংবা যে কোনো ধরনের ‘বালামুসিবত’ দূর হবে, সন্তান ধারণে অক্ষম মহিলারা এখানে মানত করলে হবেন সন্তান সম্ভবা, সারা বছরের সমস্যা দূর হয়ে সামনের জীবন হবে সুখের, সংসারে-কর্মে আসবে সাফল্য।


এমন বিশ্বাস নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানত বা ইচ্ছা পূরণের আশায় প্রতিদিন বিভিন্ন ধর্মের শত শত ভক্ত নারী-পুরুষ এখানে এসে মাজার জিয়ারত করেন এবং খিচুড়ি রান্না করেন। রান্না করা খিচুরি মাজার কর্তৃপক্ষ এবং দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করে নিজেরা খান এবং তবারক হিসেবে বাড়িতেও নিয়ে যান।


 

মীরের বাগান মাজারে ইচ্ছা পূরণের মেলা চলছে। ছবি: সময় সংবাদ


ভক্তরা বাড়ি থেকে চাল-ডাল, মুরগি, মাংস ও জ্বালানি কাঠসহ রান্নার অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে আসেন মাজারে। মাজারের সামনে চুলায় রান্না করা হয় খিচুড়ি।


ভক্তরা জানান, দুরারোগ্য অসুখ ও সন্তান কামনাসহ নানা সমস্যা সংকট নিরসনে মানত পূরণের উদ্দেশ্যে নিয়ে তারা এখানে আসেন। আর মাজার সংলগ্ন এলাকায় অস্থায়ী চুলা বানিয়ে চলে বিশেষ খিচুড়ি রান্না। আবার অনেকে মানতের বাইরে পরিবার নিয়ে পিকনিক করতেও আসেন এ মেলায়।


আরও পড়ুন: মনের আশা পূরণে হাজার বছরের রহস্যময় মসজিদটিতে মানত করে মানুষ


ভক্তদের সমাগমে মাজার আর মসজিদের সামনে এবং দুপাশের প্রায় ৪ একর জায়গা জুড়ে বসে গ্রামীণ মেলা। মেলায় চারু-কারু পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। রয়েছে নানা মিষ্টি, জিলাপি, কসমেটিকস ও মাটির খেলনা। বিভিন্ন বয়সী মানুষ ভিড় করছেন মেলায়।


মেলায় আসা সদর উপজেলার কুপতলা এলাকার আমিনুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন থেকে তাদের মনোবাসনা পূরণের আশায় এখানে আসেন এবং খিচুরি রান্না করে খাওয়া দাওয়া করেন।


স্থানীয় বাসিন্দা রেজা মিয়া জানান, সব ধর্মের মানুষ এখানে আসেন ও নিয়ত করেন। মেলার সময় ছাড়াও প্রতিদিন এখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসে।


শাহ্ সুলতান গাজী জামে মসজিদের প্রধান খাদেম ক্বারি মো. আলী আশরাফি জানান, দীর্ঘদিন থেকে এ মেলা চলে আসছে। মানুষ নিজের ইচ্ছায় এসে তাদের মনোবাসনা পূরণের জন্য দোয়া করেন। এ মেলার ব্যাপারে কাউকে ডাকতে হয় না। বৈশাখ হলে মানুষ তাদের নিজের ইচ্ছায় এখানে চলে আসেন।


মাজারের মোতোয়ালি সূত্রে জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে প্রতি বছর বৈশাখ মাসজুড়ে এ মেলা চলে আসছে এবং কয়েক শত বছর আগে এটি নির্মিত হয়েছে। এ মাজারে ঐতিহাসিক পীর শাহ সুলতান গাজী, মীর মোশারফ হোসেন ও ইবনে শরফুদ্দিন শাহ’র কবর রয়েছে।


সূত্র আরও জানায়, জঙ্গল পরিষ্কার করে খুঁজে পাওয়া যায় এখানকার মসজিদটি। মসজিদের দেয়ালে খোদিত লিপি থেকে জানা যায়, মসজিদটি স্থাপিত ১০১১ সালে। এক সময় বন জঙ্গলে ভরপুর ছিল এ জায়গাটি। ১৯০০ সালে সৈয়দ ওয়াজেদ আলী নামে এক দরবেশ এখানকার ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করে এ মসজিদ ও মাজার খুঁজে বের করে তা সংস্কার করেন। তখন থেকেই নামাজ শুরু হয় এখানে। এক সঙ্গে ৩০ জন মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন।

মানতের খিচুড়ি রান্নায় ব্যস্ত ভক্তরা। ছবি: সময় সংবাদ


স্থাপনা ও কারুকার্য

দেশের অধিকাংশ গম্বুজঅলা মসজিদের মতো শাহ্ সুলতান গাজীর মসজিদটিও তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। মাঝের গম্বুজটি অধিক কারুকার্য শোভিত ও একটু উঁচু। মসজিদের ভিতরের দেয়াল ও গম্বুজগুলোতে আরবি ও উর্দু ভাষায় খোদায় করে বিভিন্ন সুরা লেখা। খোদায় করে অলংকৃত করা হয়েছে দেয়াল। মসজিদে নেই সিমেন্ট, বালু এবং রডের ব্যবহার। চুন সুরকির গাঁথুনি দিয়ে করা গোটা নির্মাণ কাজ।


পাশেই আজান দেয়ার জন্য দোতালা মিনার, চিকন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় মিনারে। এক সময় মাইক না থাকায় মিনার থেকে আজান দেয়া হতো। এখন মসজিদের ভেতর থেকে মাইকে আজান দেয়া হয়। বুঝতে কষ্ট হয় না- বেশ কয়েকবার সংস্কার হওয়ায় মসজিদটি কিছুটা তার আদি সৌন্দর্য হারিয়েছে। মুসল্লি বেড়ে যাওয়াই সামনে টিনের ছাউনি দিয়ে নামাজের স্থান বর্ধিত করা হয়েছে।


আরও পড়ুন: মনের আশা পূরণে গায়েবি আরিফাইল মসজিদে ভিড় জমান মুসল্লিরা


শাহ্ সুলতান গাজী জামে মসজিদদের খাদেম ক্বারি মো. মোজাফর হোসেন জানান, অনেকটা অলৌকিক নির্মাণশৈলী রয়েছে। এতো বড় স্থাপনায় কোথাও ব্যবহার হয়নি সিমেন্ট, বালু এবং রডের। সংস্কার করতে গিয়ে সিমেন্ট ও বালি ব্যবহার করে এ গাঁথুনি আটকানো যায় না। দেয়াল এতো শক্ত যে ছিদ্র করতে গেলে তাতে ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়।


নির্মাণ ইতিহাস

মসজিদের পাশেই শাহ্ সুলতান গাজীর মাজার অবস্থিত। এখানে আরও ২ জন ইসলাম প্রচারকের মাজার আছে। মীর মোশাররফ হোসেন ও শরফ উদ্দিন হোসেনের। বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, তারা ইরাক থেকে সে সময় ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন এখানে। আর সে সময় নির্মাণ করেন এ মসজিদটি। তারা মারা যাওয়ার পর এখানে তাদের মাজার করা হয়।


শাহ্ সুলতান গাজী জামে মসজিদের প্রধান খাদেম ক্বারি মো. আলী আশরাফি জানান, বংশ পরস্পরায় এ মসজিদটির ইতিহাস শুনেছেন এবং এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। অন্য যে কোনো মসজিদের চেয়ে এ মসজিদটির নির্মাণ শৈলী একেবারেই আলাদা। রয়েছে নানান অলৌকিক ক্ষমতা। মাজার-মসজিদে যারা আসেন তাদের মনের বাসনা বা আশা পূরণ হয়েছেন বলে তারা আসেন।


যেভাবে যেতে হবে


গাইবান্ধা জেলা শহরের পুরাতন ব্রিজ থেকে প্রথমে দাড়িয়াপুর হাটে যেতে হবে, অটোতে ভাড়া লাগবে ১৫ টাকা। সেখান থেকে মীরের বাগান শাহ্ সুলতান গাজীর মসজিদ যেতে রিকশা বা অটোতে ভাড়া পড়বে ৫ টাকা। রিকশা বা অটো রিজার্ভ নিয়ে গেলে যাওয়া-আসা ভাড়া লাগবে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন