খুলনায় ধর্ষণ ও নির্যাতন বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে, আদালতে দেড় হাজার মামলা!

৪ সপ্তাহ আগে
খুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতনের পাশাপাশি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা। প্রতি বছর এ বিভাগে গড়ে প্রায় ৮০০ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

এসব ঘটনায় খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের তিন আদালতে এক হাজার ৫৯৮টি মামলা চলছে। এর মধ্যে শিশু নির্যাতন ও হত্যার মতো ঘটনাও রয়েছে। তবে মামলায় দৃষ্টান্তমূলক সাজা না থাকায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

 

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্যমতে, সবশেষ গত ১৪ মার্চ দুপুরে খুলনা নগরীর ৭ নম্বর ঘাট এলাকায় বয়স্ক এক ব্যক্তি রিকশার মধ্যে এক শিশুকে যৌন নির্যাতন করে। মোবাইলে ধারণ করা ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়।

 

এ ঘটনায় খালিশপুর থানায় মামলা করেন শিশুটির মা। পরবর্তীতে ১৭ মার্চ অভিযুক্ত কালু শেখকে (৬৫) আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে আইনের আওতায় এলেও এমন ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই।


খুমেকের তথ্য মতে, প্রতি বছর বিভাগের ৮০০ নারী ও শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনে শিকার হয়ে হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের ভর্তি হন। যার বড় একটি অংশ ধর্ষণের শিকার।


আরও পড়ুন: গণঅভ্যুত্থানে শহীদের মেয়েকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ


২০২৩ সালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন ৭০৮ রোগী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৪৮৮ জন এবং যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ শিকার ২১৪ জন। এর মধ্যে ১৫৫ জনই শিশু।


২০২৪ সালে ভর্তি হন ৭৮৮ রোগী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৫৫৯ জন এবং যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার ২২৮ জনের মধ্যে ১৭০ জনই শিশু। আর ২০২৫ সালের ১৮ মার্চ পর্যন্ত ভর্তি হন ১৫৫ জন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ১১১ জন ও ধর্ষণের শিকার ৪৪ জনের মধ্যে ৩২ শিশু।


পরিসংখ্যান বলছে, খুলনা বিভাগে গড়ে প্রতিদিন একজন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হন। ২০২৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত খুলনা বিভাগে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ৩৫৭টি শিশু।


আরও পড়ুন: রাজধানীতে নারী সাংবাদিককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ


খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কো-অর্ডিনেটর ডা. শামীম হাসান বলেন, ‘বিভাগের সব জেলার রোগী এই হাসপাতালেই আসেন। এখানে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ ও নির্যাতনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি আইনি সহায়তা দেয়া হয়।’


তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধর্ষণের শিকার হওয়া রোগীদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা বেশি। এখানে মেডিকেল পরীক্ষার পাশাপাশি ডিএনএ সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। অনেক সময় ডিএনএর রিপোর্ট পেতে সময় লাগে। তবে রিপোর্ট দ্রুত পাওয়া গেলে বিচারিক কাজে সুবিধা হতো।


এদিকে খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের তিন আদালতে মামলা রয়েছে এক হাজার ৫৯৮টি। এর মধ্যে নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনাও রয়েছে।


আরও পড়ুন: কেমন আছে খিলক্ষেতে ধর্ষণের শিকার শিশুটি?


আদালতের নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলার ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই শিশু।


নারী-শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ও আইনজীবীরা বলেন, শিশুদের সহজে প্রলোভন, পারিবারিক অসচেতনতা, ধর্মীয় ও সামাজিক নৈতিকতার অবক্ষয়, প্রভাবশালীদের চাপ, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে কমছে না এ ধরনের অপরাধ।


খুলনা সম্মিলিত নারী অধিকার সুরক্ষা ফোরামের সদস্য সচিব সুতপা বেদজ্ঞ বলেন, ‘আমরা মনে করি এটা সমাজ ও পরিবারের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে হচ্ছে। এ ছাড়া একটি ঘটনারও দৃষ্টান্তমূলক সাজা আমরা দেখি না। তার জন্যই অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তারা সাহস পাচ্ছে। তারা একের পর এক ঘটনা ঘটাচ্ছে।’


আরও পড়ুন: গণঅভ্যুত্থানে শহীদের মেয়েকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ


তিনি আরও বলেন, ‘দেখবেন একটা গ্রাম বা একটা এলাকায় খুব বেশি মানুষ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে না। যারা করছে বারবারই করছে। এর আগে আমরা দেখেছি দলীয় পরিচয়ে একের পর এক ধর্ষণ করে গেছে। সেটা নিয়ে কোনো বিচার হয়নি। বিচার হয় না বলেই বিচারহীনতার কারণেই ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয় হলো আমাদের নৈতিক এবং নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এ রকম ধর্ষণে ঘটনা ঘটছে।’


খুলনা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট হালিমা আক্তার খানম বলেন, ‘শাস্তির নিশ্চয়তা আমরা শত ভাগ দিতে পারছি না। দুর্বলতা, পারিপার্শ্বিকতা, পারিবারিক এবং বিভিন্ন মহলের চাপের কারণে সাক্ষীরা সঠিক সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। কিছু কিছু মামলা আপস হয়ে আসছে। আবার টাকার বিনিময়েও আপস করছে। সাক্ষীরা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। যে কারণে বিচারটা নিশ্চিত হচ্ছে না।’


খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার এমএম শাকিলুজ্জামান বলেন, ‘পরিবার সবকিছুর কেন্দ্র। আপনার বাচ্চাটি কার কাছে থাকছে, কোথায় যাচ্ছে, তাকে আপনি শৈশবে অনেক কিছু শিখিয়ে দিলেন, যেমন গুড টাচ, ব্যাড টাচ কি? কোথায় সতর্ক হতে হবে।’


আরও পড়ুন: যশোরে থানা থেকে ধর্ষণ মামলার আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে মারধর


তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা আছে। সমাজকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা সেই সমাজের একটি অংশ। এখানে কোনো একটি দায়িত্ব হয়তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে আমরা পালন করছি এবং সেটি আমরা করব। আমরা কাউকেই ছাড় দেব না, দেইওনি। এটি প্রশ্নই আসে না। এই ধরনের যে কোনো ঘটনা হওয়া মাত্রই আমাদের একদম শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা তৎপর হয়ে যান। কারণ আমরাও এই সমাজের মানুষ আমাদেরও পরিবার আছে।


এমএম শাকিলুজ্জামান আরও বলেন, ‘এ ধরনের নৃশংসতা নিষ্ঠুরতা দুঃখজনক ঘটনা। এটি কোথাও ঘটুক, এটি আমরা চাই না। কিন্তু আপনার ঘরের মধ্যে তো, আমি সব সময় থাকতে পারবো না। এটি আসলে সমর্থনযোগ্যও না। আপনার ঘরের মধ্যে কি হচ্ছে, সে বিষয়টি কিন্তু আপনাকেই আগে লক্ষ্য রাখতে হবে। আপনার সন্তান কীভাবে বেড়ে উঠছে, কোন পরিসরে বেড়ে উঠছে, এটি আপনাকে লক্ষ্য করতে হবে। নাগরিক সমাজ, সুধী সমাজ, সর্বোপরি গোটা সমাজকে এই দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবার হলো সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। পরিবারের যারা অভিভাবক আছেন, বাবা-মা আছেন, তাদের সচেতন হতে হবে।’
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন