২০১০ সালে কাজ শুরু হয় খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্পের। বৈদেশিক ঋণ সহায়তায় নির্মিত খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে ভারতের এলঅ্যান্ডটি এবং ইরকন ইন্টারন্যাশনাল। প্রকল্পের অংশ হিসেবে নির্মিত হয়েছে রূপসা নদীর ওপর ৫.১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি রেলসেতু; যা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় রেলসেতু। এই রেললাইন খুলনা ও মোংলা বন্দরের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেছে।
নানা জটিলতার কারণে চার দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালে ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ উদ্বোধন করা হয়। প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হয়েছে নয়টি স্টেশন, একটি বড় রেলসেতু, ৬৬টি ছোট সেতু এবং ২৪৬টি কালভার্ট। লক্ষ্য ছিল মোংলা বন্দরে আমদানি করা পণ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রেলপথে পরিবহনের মাধ্যমে সময় ও ব্যয় কমানো।
আরও পড়ুন: রেলযাত্রা / অনলাইন-কাউন্টার দুই পথেই টিকিটের লড়াই, রংপুরবাসীর ভোগান্তি বাড়ছে
তবে উদ্বোধনের পর থেকে পণ্য পরিবহন কার্যক্রম প্রায় স্থবির। রেলওয়ে সূত্র জানায়, দেড় বছরে মাত্র তিনবার পণ্য পরিবহন করা হয়েছে। ২০২৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সাড়ে ৭ হাজার মেট্রিক টন, ২৩ মার্চ সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন এবং ২৫ জুন ৬ হাজার মেট্রিক টন চট্টগ্রাম থেকে সিরাজগঞ্জে পরিবহন করা হয়েছে। এরপর থেকে আর কোনো চালান করা হয়নি।
এত বিশাল বিনিয়োগের পরও প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত সুফল না আসায় হতাশ সাধারণ মানুষও। স্থানীয়দের দাবি, দ্রুত পণ্যবাহী ট্রেন চালু হলে এলাকাবাসীর কর্মসংস্থান বাড়বে, শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে এবং দক্ষিণাঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে।
মোংলা বন্দরের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও বড় আকারের জাহাজ প্রবেশে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় আমদানিকারকরাও পণ্য পরিবহনে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বন্দরে আধুনিক ক্রেন, গুদাম ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং সুবিধার ঘাটতি থাকার পাশাপাশি পণ্য খালাস ও পরিবহন প্রক্রিয়ায় ধীরগতি ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করছে।
জেইন ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মো. সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, ‘মোংলা বন্দর ও রেলওয়ের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকায় এই রেলপথ এখনও পণ্য পরিবহনের মূলধারা গড়ে তুলতে পারেনি। অবকাঠামো আছে, কিন্তু সমন্বয় নেই ফলে সম্ভাবনা কাজে লাগছে না।’
রেলওয়ে কর্মকর্তাদের দাবি, তারা পণ্যবাহী ট্রেন চালাতে প্রস্তুত। কিন্তু বন্দরের সীমিত আমদানি কার্যক্রমের কারণে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবস্থাপক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা রেক ও ইঞ্জিনসহ সব প্রস্তুতি রেখেছি। কিন্তু পর্যাপ্ত পণ্য না থাকায় নিয়মিত ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। মোংলা বন্দরে পণ্য প্রবাহ বাড়লেই রেলওয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।’
রেলওয়ে আরও জানায়, আমদানিকারকদের আগ্রহী করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। স্থানীয় শিল্প এলাকা, রফতানিকারক ও আমদানিকারকদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে তারা রেলপথ ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন বাড়াতে আগ্রহী হন। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) মো. কামাল হোসেন জানান, ‘আমদানি কার্যক্রম বাড়াতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বন্দর টার্মিনাল সম্প্রসারণের কাজ চলছে। আমদানিকারকদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়ার বিষয়ও বিবেচনায় আছে।’
আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুর পরও জ্বালানি অনিশ্চয়তায় খুলনাঞ্চলে ডানা মেলেনি শিল্পপ্রতিষ্ঠান
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনার ঘাটতি ও সমন্বয়ের অভাবের কারণে খুলনা-মোংলা রেলপথের সম্ভাবনা এখনো থেমে আছে। রেলওয়ে, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ নিলে এই রেললাইন শুধু বন্দরকেন্দ্রিক অর্থনীতি নয়, পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায় রচনা করতে পারবে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির মনে করেন, ‘খুলনা-মোংলা রেলপথ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারত। কিন্তু রেলপথে নিয়মিত পণ্য পরিবহন শুরু না হলে এই বিনিয়োগ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না। সরকারকে এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে যাতে বন্দর, রেলওয়ে ও বাণিজ্যিক অংশীদাররা একই ছাতার নিচে কাজ করতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এই রেলপথটা তৈরি করেছি ঋণের টাকায়। ফলে প্রতিনিয়ত ঋণে সুদের পরিমাণ বাড়ছে। এই রেল লাইনকে লাভজনক করতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। এই অঞ্চলে শিল্পনগরী, রফতানিমুখী অর্থনীতি ও কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য এ রেললাইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পণ্য পরিবহন কার্যক্রম শুরু হলে শুধু মোংলা নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।‘
]]>
৪ সপ্তাহ আগে
৪







Bengali (BD) ·
English (US) ·