সমাজের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য ‘বাংলাদেশ প্রাইজবন্ড’ নামে এই বন্ড চালু করে সরকার। এটি যেকোনো সময় কেনা ও ভাঙানো যায়।
প্রাইজবন্ড কী?
প্রাইজবন্ড হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি বিনিয়োগ প্রকল্প যেখানে বিনিয়োগকারী যেকোনো সময় বিনিয়োগ করতে পারবেন এবং যেকোনো সময় প্রাইজবন্ড ফেরত প্রদান করে আসল উত্তোলন করতে পারবেন। উক্ত প্রকল্প হতে মুনাফা বা সুদ প্রদান করা হয় না। তবে প্রতি বছর তিন মাস অন্তর অন্তর ড্র অনুষ্ঠিত হয় এবং উক্ত ড্রয়ের মাধ্যমে বিজয়ীদের বিভিন্ন মূল্যমানের পুরস্কার প্রদান করা হয়।
আরও পড়ুন: প্রাইজবন্ডের ১১৯তম ‘ড্র’, লাখ টাকা পুরস্কার পেল যেসব নম্বর
বছরের ৩১ জানুয়ারি, ৩০ এপ্রিল, ৩১ জুলাই ও ৩১ অক্টোবর তারিখে ড্র অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ নির্ধারিত আছে। নির্ধারিত তারিখে কোনো সরকারি ছুটি থাকলে পরবর্তী কার্যদিবসে ড্র অনুষ্ঠিত হয়।
তবে বিক্রিত সকল বন্ডই লটারির আওতায় আসে না। যে তারিখে ড্র অনুষ্ঠিত হবে সেই তারিখ থেকে ২ মাস আগে (ইস্যু'র / বিক্রির তারিখ থেকে 'ড্র' এর তারিখ বাদ দিয়ে) যে সমস্ত নতুন বন্ড বিক্রি হবে তাসহ পূর্বের বিক্রিত বন্ড ড্রয়ের আওতায় আসবে। অর্থাৎ বন্ডে নির্দেশিত বিক্রির তারিখ থেকে ন্যূনতম ২ মাস অতিক্রমের পর উক্ত বন্ড ড্র-এর আওতায় আসবে।
সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে 'ড্র' অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং সরকার কর্তৃক নিয়োজিত 'ড্র' কমিটি কর্তৃক 'ড্র' অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়ে থাকে। একক সাধারণ পদ্ধতিতে 'ড্র' পরিচালিত হয় (অর্থাৎ প্রত্যেক সিরিজের জন্য একই নম্বর)। বাজারে প্রচলিত প্রাইজবন্ড সিরিজগুলো এই 'ড্র'-এর আওতাভুক্ত।
প্রাইজবন্ড কেন প্রচলন করা হয়েছে?
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এই স্কীমটি চালু করে। এই প্রকল্পটি সকল শ্রেণির জনসাধারণের সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করেই প্রবর্তন করা হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎস হতে প্রয়োজনীয় অর্থ আহরণ অনেকটাই সহজ। প্রাইজবন্ড বিক্রির মাধ্যমে সরকার সরাসরি জনগণের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকে।
বর্তমানে কত টাকা মূল্যের প্রাইজবন্ড বাজারে চালু আছে?
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রবর্তিত প্রাইজবন্ডের প্রকল্প সংখ্যা তিনটি। সেগুলো হলো- ১৯৭৪ সালে প্রবর্তিত ১০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ড। যা ১৯৯৫ সালে বাতিল করা হয়। এছাড়া ১৯৭৪ সালে ৫০ টাকা মূল্যমানের আরেকটি প্রাইজবন্ড চালু করা হয়েছিল, যেটিও ১৯৯৫ সালে বাতিল করা হয়।
তবে বর্তমানে শুধুমাত্র ১০০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ড বাজারে চালু আছে। ১৯৯৫ সালের ২ জুলাই থেকে এ বন্ড বাজারে প্রচলন শুরু হয়।
কেন কিনবেন প্রাইজ বন্ড?
সারাজীবন কষ্ট করে হয়তো কিছু টাকা জমিয়েছেন। কিন্তু কোথায় টাকা খাটাবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না। কারণ যে কোনো বিনিয়োগের ঝুঁকি থাকে। কিন্তু প্রাইজ বন্ডে কোনো রিস্ক নেই। খুব ক্ষুদ্র সঞ্চয় দ্বারা আলাদাভাবে অর্থনীতিতে কোনো লাভজনক বিনিয়োগ সম্ভব নয়।
মাত্র ১০০ টাকায় অন্য কোনোভাবে সঞ্চয় বা বিনিয়োগ করা কষ্টকর বলা চলে। আবার অন্য কোনো বিনিয়োগ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে মূলধন প্রত্যাহার সম্ভব নয়। তবে প্রাইজবন্ড ভাঙিয়ে যে কোনো সময় নগদ অর্থ তুলে নেয়া যায়। এটি সহজে হস্তান্তর যোগ্য। ব্যাংক বা অন্য কোথাও সঞ্চয় জমা রাখলে তা সহজে হস্তান্তর যোগ্য নয়। কিন্তু আপনার অধিকারে থাকা প্রাইজবন্ড যে কোনো সময় যে কাউকে হস্তান্তর করা সম্ভব। কোনো দালিলিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ড্র এর সময় বন্ড যার হাতে থাকবে সেই পুরস্কার লাভ করবে।
কীভাবে কিনবেন?
প্রাইজবন্ড কিনতে কোনো আবেদন করতে হয় না। যেকোনো ইস্যু অফিসে উপস্থিত হয়ে নগদ অর্থের বিনিময়ে প্রাইজবন্ড ক্রয় করা ও ভাঙানো যায়। বর্তমানে দেশে চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাইজবন্ড কেনা ও ভাঙানো যায়।
১) বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল অফিস (ময়মনসিংহ অফিস ব্যতীত)
২) শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক ব্যতীত সকল তফসিলি ব্যাংক
৩) জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের অধীনস্থ সকল সঞ্চয় ব্যুরো অফিস
৪) ডাকঘর
প্রাইজবন্ড 'ড্র' পদ্ধতি কেমন?
বাংলাদেশ প্রাইজবন্ড স্কিমের অধীনে প্রাইজবন্ড বিক্রয়, 'ড্র' অনুষ্ঠান এবং পুরস্কারের টাকা প্রদানের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে প্রাইজবন্ড 'ড্র' কমিটির চেয়ারম্যান (বিভাগীয় কমিশনার) কর্তৃক নির্দেশিত পূর্ব নির্ধারিত স্থানে 'ড্র' অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়ে থাকে। চেয়ারম্যান 'ড্র' অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং অনুমোদিত পদ্ধতি মোতাবেক 'ড্র' অনুষ্ঠানের বিষয়টি সুনিশ্চিত করেন।
উক্ত 'ড্র' অনুষ্ঠানটি বিটিভি বা অন্য কোনো চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় না, তবে বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে উক্ত 'ড্র' অনুষ্ঠানে প্রচুর জনসাধারণ, মিডিয়া প্রতিনিধি, সংবাদ মাধ্যম উপস্থিত থাকে। অদ্যাবধি উক্ত অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংক অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে আসছে, কখনো কোনো বিরূপ পরিবেশ তৈরি হয়নি।
চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত গেজেটেড কর্মকর্তারা অর্থাৎ ড্রয়িং অফিসার 'ড্র' পদ্ধতিটি পাঠ, ড্রাম ঘুরানো, গুটি উত্তোলন, ড্রামের সঙ্গে রক্ষিত ট্রে-তে গুটিগুলো স্থাপন ইত্যাদি কার্যক্রম সুচারুভাবে পালন করে থাকেন এবং সদস্যগণ অন্যান্য কাজের সাথে পুরস্কার বিজয়ী নম্বর রেকর্ড করা এবং নির্ধারিত পদ্ধতি মোতাবেক ও বিরতিহীনভাবে 'ড্র' অনুষ্ঠানের নিমিত্তে সার্বিক তত্ত্বাবধান করে থাকে।
প্রাইজবন্ড 'ড্র'অনুষ্ঠানের প্রায় দেড় মাস পূর্ব হতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের নির্দেশনার আলোকে মতিঝিল অফিসের প্রাইজবন্ড শাখার উপ-ব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে 'ড্র' অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। প্রাইজবন্ড 'ড্র' কমিটির সভাপতি মহোদয় ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রাইজবন্ড শাখার কর্মকর্তা বা কর্মচারীদেরকে প্রাইজবন্ড নীতিমালায় বর্ণিত কার্যাবলী মোতাবেক যার যার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হয় এবং উক্ত দায়িত্ব পালনে ব্যত্যয় ঘটার কোনো সুযোগ নেই ।
চলুন জেনে নেয়া যাক যেভাবে সহজেই প্রাইজবন্ডের ড্রয়ের ফলাফল জানবেন-
সহজেই প্রাইজবন্ড ড্রয়ের ফলাফল জানবেন যেভাবে
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েব সাইটের সার্চ বক্সে প্রতিবারে এক বা একাধিক নম্বর অনুসন্ধান করা যাবে। একটি নম্বরের জন্য শুধুমাত্র নম্বরটি টাইপ (সিরিজ নয়) করলেই ফলাফল জানা যাবে। যদি একাধিক প্রাইজবন্ড থাকে এবং তা যদি ক্রমানুসারে হয় তাহলে শুধুমাত্র প্রথম ও শেষ নম্বরের মাঝে হাইফেন (-) টাইপ করে সমস্ত নম্বর অনুসন্ধান করা যাবে। আর যদি একাধিক প্রাইজবন্ড থাকে এবং তা যদি ক্রমানুসারে না হয় তাহলে কমা (,) দ্বারা আলাদা করে সমস্ত নম্বরগুলো টাইপ করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ফলাফল জানা যাবে।
এছাড়া প্রাইজবন্ডের লটারির ফলাফল জানার জন্য বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ চালু করেছে প্রাইজ বন্ড রেজাল্ট ইনকুয়্যারি সফটওয়্যার (পিবিআরআইএস)। যার ওয়েব এড্রেস হলো www.irdbd.online।
এ সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে ২টি পদ্ধতিতে ফলাফল অনুসন্ধান করা যাবে। সার্চ বক্সে সরাসরি নম্বর লিখে এবং নম্বর আপলোড করে অনুসন্ধান করা যাবে।
প্রথম পদ্ধতির ক্ষেত্রে সার্চ বক্সে প্রাইজবন্ডের নম্বরটি (সিরিজ ব্যতীত) বাংলায় অথবা ইংরেজিতে অনুসন্ধান করা যাবে। একসঙ্গে একাধিক নম্বর অনুসন্ধান করলে নম্বরগুলোকে কমা (,) দিয়ে আলাদা করতে হবে। ধারাবাহিক নম্বর অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্রথম ও শেষ সংখ্যার মধ্যে হাইফেন (-) ব্যবহার করতে হবে।
আরও পড়ুন: প্রাইজবন্ড ড্রয়ের পদ্ধতি, সহজে ফলাফল জানবেন যেভাবে
দ্বিতীয় পদ্ধতির ক্ষেত্রে মাইক্রোসফট এক্সেল সিটের কলাম এ তে প্রাইজবন্ডের নম্বরগুলো (সিরিজ ব্যতীত) ইংরেজিতে লিখে শেষ করতে হবে। তারপর এক্সেল ফাইলটি সরাসরি সফটওয়্যারে আপলোড দিতে হবে। অনুসন্ধানের তারিখ শুরু করে পূর্ববর্তী ২ বছরের মধ্যে প্রকাশিত সব ফলাফলের বিপরীতে কোনো মিল পেলে ফলাফলের কপি দেখাবে।
এই সফটওয়্যার থেকে প্রাইজবন্ড ক্রেতারা পুরস্কারের টাকা দাবি ফরম ডাউনলোড করতে পারবেন। সেই সঙ্গে প্রাইজবন্ডের ড্র বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারবেন।
ক্রেতারা এ সফটওয়্যারে বিনামূল্যে ই-মেইল সাবস্ক্রিপশন করতে পারবেন। এতে সাবস্ক্রিপশনপ্রাপ্ত নাগরিকরা প্রতি ৩ মাস পরপর প্রকাশিত ফলাফল সম্পর্কে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইমেইলে অবহিত হতে পারবেন।
পুরস্কার
প্রাইজবন্ডে প্রথম পুরস্কার বিজয়ীকে ৬ লাখ টাকা দেয়া হয়। দ্বিতীয় পুরস্কার বিজয়ীকে দেয়া হয় তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা করে। তৃতীয় পুরস্কার বিজয়ী এক লাখ টাকা করে এবং চতুর্থ পুরস্কার বিজয়ী ৫০ হাজার টাকা করে পান। পঞ্চম পুরস্কার বিজয়ী প্রত্যেককে দেয়া হয় ১০ হাজার টাকা করে। প্রাইজবন্ডের পুরস্কারের জন্য ঘোষিত সংখ্যার প্রতিটি সিরিজের সেই সংখ্যার বন্ড একই পুরস্কারের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
পুরস্কার দাবির সময়সীমা দুই বছর। পুরস্কার দাবির তারিখ থেকে সাধারণত দুই মাসের মধ্যে পুরস্কারের অর্থ পাওয়া যায়। মূলত প্রাপকের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে পুরস্কারের অর্থ জমা হয়ে যায়। তবে আয়কর আইন ২০২৩ এর ১১৮ ধারার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাইজবন্ডে পুরস্কারের অর্থ থেকে ২০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটার বিধান রয়েছে।
]]>