এই সেই সীমান্ত, যা একদিন দুই প্রতিবেশী দেশের মানুষের হৃদয়ের সংযোগ স্থাপন করেছিল, আজ তা নির্মম বিচ্ছেদের নীরব সাক্ষী। হাজারো পরিবার, যাদের সদস্যদের পরিচয় শুধু ভারতীয় বা পাকিস্তানি বলে, তাদের স্বপ্নগুলো এই সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে যাচ্ছে।
কাশ্মীরের পহেলগামে নৃশংস হামলার জেরে ভারত সরকারের আকস্মিক নির্দেশে পাকিস্তানি নাগরিকদের অবিলম্বে দেশ ছাড়তে হচ্ছে। ফলে মায়েরা তাদের পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য হচ্ছেন সন্তানদেরও ত্যাগ করতে। সায়রা সেসব ভুক্তভোগী মায়েদেরই একজন। যাকে তার মাত্র ৯ মাস বয়সি বুকের ধন আজলানকে রেখে ফিরতে হচ্ছে পাকিস্তানে।
পাকিস্তানের করাচির মেয়ে সায়রা। এখন থেকে তিন বছর আগে প্রেমের টানে পাড়ি জমান ভারতের নয়াদিল্লিতে। ঘর বাঁধেন ফারহানের সঙ্গে। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি তাদের সুখের নীড় ভেঙে দিল। গত মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) সকালে নয়াদিল্লি থেকে আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে এসে পৌঁছান সায়রা ও ফারহান।
একটু পরই ঘনিয়ে আসে বিদায়ের ক্ষণ। বিদায় বেলায় তারা শেষবারের মতো একে অপরের দিকে তাকায়। হাতে হাত রেখে শক্ত করে ধরে। তাদের চোখ ভিজে যায়। এর মধ্যে বেরসিক সীমান্তরক্ষী ছুটে এসে তাদের আলাদা করে দেয়। কাঁটাতারের বেড়া আর ব্যারিকেডের সীমান্তে তাদের একমাত্র পরিচয়- সায়রার সবুজ পাসপোর্ট, আর ফারহানের নীল।
আরও পড়ুন: সন্তানদের চিকিৎসা না করেই ভারত ছাড়তে হচ্ছে পাকিস্তানি দম্পতির!
তখন ফারহান তার ছোট্ট ছেলে আজলানের নরম গালে শেষ চুমুটি এঁকে সায়রার কানে ফিসফিস করে বলেন, ‘ইনশাল্লাহ, আমাদের শিগগিরই দেখা হবে। আমি তোমাদের জন্য দোয়া করব।’ এরপর সায়রা যখন তার কলিজার টুকরাকে নিয়ে সীমান্ত পেরনোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখনই এক অপ্রত্যাশিত বাধা।
সীমান্তরক্ষীর দৃষ্টি তাদের শিশুপুত্র আজলানের নীল পাসপোর্টের ওপর পড়লো। কর্কশ কণ্ঠে রক্ষী বলে উঠেলো, ‘বাচ্চা নেয়া যাবে না, ম্যাডাম! আপনাকে একাই যেতে হবে।’ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহূর্তে ছিন্ন হলো এই দম্পতির ভালোবাসার বন্ধন। সায়রা চললেন করাচির পথে, আর ফারহান দুধের শিশু আজলানকে নিয়ে ফিরে চললেন নয়াদিল্লি।
‘এ যেন এক অন্তহীন নির্বাসন’
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকধারীরা ২৬ জন বেসামরিক নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে, যাদের বেশিরভাগই ছিল পর্যটক। তখন থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে। এ ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেছে। ইসলামাবাদ সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ‘নিরপেক্ষ তদন্ত’র আহ্বান জানিয়েছে।
কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতির বদলে ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে গোলাগুলি চলছে। ভারত দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে। পাকিস্তানও কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থেকের বের হয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে। উভয় দেশ একে অপরের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
এমনকি উভয় দেশই বসবাসরত প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের ভিসা বাতিল করে অবিলম্বে দেশে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে। সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। ভারত সরকারের নির্দেশের পর গত ২২ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ জন পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ফিরেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে ফিরেছেন প্রায় এক হাজার ভারতীয়।
এই পরিস্থিতিতে সীমান্তের দুপাশে আটকে পড়েছে দুই দেশের হাজারো পরিবার। তাদের মধ্যে আছেন দুই দশক পর ভারতে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে আসা পাকিস্তানি নারী, ভারতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসা দুই বোন- যাদের অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়েই ফিরতে হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন বয়স্ক পাকিস্তানি রোগী যারা চিকিৎসার আশায় ভারতে এসেছিলেন।
আরও পড়ুন: স্বামী পাকিস্তানে, স্ত্রীকে সীমান্তে আটকে দিলো ভারত!
এ তালিকায় হালিমা বেগম নামে ৪৮ বছর বয়সি এক নারীও আছেন। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওডিশা থেকে দুই দিন ধরে দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে আটারি সীমান্তে পৌঁছান তিনি। হালিমা বেগমও পাকিস্তানের করাচির মেয়ে। এখন থেকে ২৫ বছর আগে তিনিও প্রেমের টানে দেশ ছাড়েন। বিয়ে করেন ওডিশার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে।
তাদের জীবন মোটামুটি ভালোই চলছিল। এর মধ্যেই এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে তার হাতে ভারত সরকারের ‘ভারত ছাড়ো’ নোটিশ ধরিয়ে দেন। সীমান্তের কাছে অনেকগুলো ব্যাগ নিয়ে একটি ট্যাক্সিতে বসা হালিমা বলছিলেন, ‘আমি ভীষণ ভয় পেলাম। আমি তাদের বললাম, আমি তো এখানে এমনি এমনি আসিনি, আমার বিয়ে হয়েছে ভারতে।’
হালিমার কণ্ঠে অনুযোগ, ‘ভারত সরকার যে আমার এত বছরের গড়ে তোলা জীবনটা এক ঝটকায় উপড়ে ফেলছে এবং আমাকে বের করে দিচ্ছে, এটা কি ন্যায্য হচ্ছে?’ ২৫ বছর ভারতে কাটানো হালিমা বলেন, এই দেশটা এখনও তারও দেশ।
হালিমার সঙ্গে ছিলেন তার দুই ছেলে। ২২ বছর বয়সি মুসাইব আহমেদ ও ১৬ বছরের যুবায়ের আহমেদ। আট বছর আগে তাদের বাবা মারা গেছেন। দুই ভাই মিলে ঠিক করেন, যুবায়ের সীমান্ত পার হয়ে মায়ের সঙ্গে যাবে, যেন মায়ের দেখাশোনা করতে পারে।
আরও পড়ুন: কাশ্মীরে হামলাকারীদের অবশ্যই বিচার হবে: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
কিন্তু তাদের দুইজনের পাসপোর্টই নীল (ভারতীয়)। আর হালিমার পাসপোর্ট সবুজ (পাকিস্তানি)। মুসাইব ও যুবায়ের শুরুতে সীমান্তরক্ষীদের কাছে কাকুতি-মিনতি করেন, এমনকি শেষে তর্কেও জড়ান। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। মুসাইব বলেন, ‘মা কখনও একা কোথাও যাননি। আমি জানি না, তিনি এতটা পথ কীভাবে যাবে।’ সীমান্ত থেকে করাচি যাওয়ার কথা বলছিলেন তিনি।
তার ওপর করাচিতে হালিমার যাওয়ার মতো এখন আর কোনো বাড়ি নেই। হালিমা বলছিলেন, ‘ আমার মা-বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। একমাত্র ভাই নিজের ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে মাত্র দুটি কক্ষে থাকেন। হাজারটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। কিন্তু একটারও জবাব নেই। শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া, তিনি যেন আমার সন্তানদের নিরাপদ রাখেন। খুব শিগগির আমরা আবার এক হব।’
রাতারাতি টানা সীমান্তে ভাগ হয়ে যাওয়া মানুষের গল্প নিয়ে ২০২২ সালে প্রকাশিত হয় ‘মিডনাইটস বর্ডারস’ বইটি। এর লেখিকা সুচিত্রা বিজয়ন বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে এমন অসংখ্য হৃদয় বিদারক কাহিনি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে।’
সুচিত্রার মতে, ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের পর থেকে যেসব মুসলিম নারী ভারত কিংবা পাকিস্তানে জন্ম নিয়ে অন্য দেশের পুরুষদের বিয়ে করে চলে গেছেন, তারাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। বিশেষ করে যখন তাদের জোর করে ফেরত পাঠানো হয়, তখন তাদের অনেক সংকটের মধ্যে পড়তে হয়।
আরও পড়ুন: ভারতে নামাজের জন্য বাস থামিয়ে বেকায়দায় চালক!
সুচিত্রা বিজয়ন বলেন, ‘(বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর) আপনি এমন এক জায়গায় বন্দি হয়ে পড়বেন, যা আর আপনার ঘর নয়- অথবা এমন একটা ঘর, যেটাকে আপনি চিনতেও পারবেন না। নির্বাসন হয়ে ওঠে আপনার জীবনের স্বাভাবিক অবস্থা।’
সায়রা ও ফারহানের মতো করে বিগত কয়েক দশকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের টানাপোড়েনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বহু পরিবার এ আশায় বুক বেঁধে থেকেছে যে অচিরেই তারা আবার মিলিত হবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবে তা ঘটেনি। সুচিত্রা বিজয়ন বলেন, ‘সবচেয়ে বেদনাদায়ক যে কথা বারবার শুনবেন, সেটা হলো- অনেকে ভেবেছিলেন যে তাঁরা সাময়িকভাবে যাচ্ছেন।’
]]>