ঐতিহ্যবাহী বিনিময় প্রথার শুঁটকি মেলায় কোটি টাকার বেচাকেনা!

২ দিন আগে
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে দুদিন ব্যাপী ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি মেলায় মানুষের ঢল নেমেছে। শতাব্দী প্রাচীন বিনিময় প্রথার এই শুঁটকি মেলায় এখন নগদ টাকায় কেনাবেচা হয়। মেলায় দুদিনে অন্তত কোটি টাকার শুঁটকি বেচাকেনার হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) নাসিরনগর উপজেলার সদর ইউনিয়নের কুলিকুণ্ডা গ্রামে ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি মেলা শুরু হয়। আজ বুধবার (১৬ এপ্রিল) মেলার শেষ দিন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমাগমে মুখরিত হয়ে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণ; নেমেছে মানুষের ঢল।


আয়োজকরা জানান, এক সময় মেলায় সদ্যতোলা ফসলের বিনিময়ে পণ্য বিনিময় হলেও মুদ্রা প্রচলন হওয়ায় এর জোলস কমেছে অনেকটাই।


সরেজমিনে শুঁটকি মেলায় কথা হয় নাসিরনগরের জেঠাগ্রাম গ্রামের জ্যোৎস্না চৌধুরীর সঙ্গে; তিনি জানান, প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী মেলায় তিনি শুঁটকি নিয়ে এসেছেন। গত দুই দশক ধরে তিনি এই মেলায় আসছেন। আলু, বেগুন ঢেঁড়স, মিষ্টিআলু, সিমের বিচিসহ সদ্যতোলা বিভিন্ন ফসলের বিনিময়ে তিনি শুঁটকি বিক্রি করছেন। তবে কালের আবর্তে মেলার জৌলুশ কমেছে।


জ্যোৎস্না আরও জানান, আগে মানুষ সদ্যতোলা ফসল দিয়ে বিনিময় করতেন। এখন আর আগের মতো করেন না। কারণ শুঁটকির দাম বেড়ে গেছে, আর সবজির দাম কম। তাই মানুষ আর বিনিময় করতে আসেন না। তারপরও ঐতিহ্যগতভাবে যেহেতু মেলাটি চলেছে, তাই প্রথা অনুযায়ী অংশগ্রহণ করেছি। কিছুটা বিনিময় হয়েছে। তাতেই খুশি বলে জানান তিনি।


আরও পড়ুন: শুঁটকি উৎপাদন: লাভের গুড় ‘দাদনে’ খায়!

 

মেলায় আসা ৯০ বছর বয়সী আহাদ আলী জানান, ‘বাপদাদাসহ আমাদের চার পুরুষ আগ থেকে এই মেলা চলে আসছে। কম করে হলেও মেলার বয়স ৪০০ বছর হবে। মোগল আমলে যখন করির প্রচলন ছিল। তখন কুলিকুণ্ড গ্রামের মানুষ এই শুঁটকি মেলায় পণ্যের বিনিময় করতো। বিশেষ করে ধান, আলু, সিমের বিচি, তরিতরকারি বদল করে তারা শুঁটকি নিতেন। তবে মুদ্রার প্রচলন হওয়ার পর  শুঁটকি মাছেরও মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এই বিনিময় প্রথা কমেছে অনেকটাই। তবে টাকায় এখন মেলায় বিপুল পরিমাণ বেচাকেনা হয় বলে জানান বৃদ্ধ আহাদ আলী।


জানা যায়, মেলায় প্রতি কেজি বোয়াল মাছের শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকায়, কাইক্কা বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়, কাচকি শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়, শোল শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকায় এবং বাইম মাছের শুঁটকি কেনাবেচা হচ্ছে ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকায়। এ ছাড়া কিছু সামুদ্রিক মাছের শুঁটকিও এনেছেন দোকানিরা।


মেলায় সুনামগঞ্জ থেকে শুঁটকি মাছ নিয়ে আসা সুবল দাস জানান, তিনি হাওড় থেকে বোয়াল, আইর, শোল, গজার মাছের শুঁটকিসহ দেশীয় মাছের শুঁটকি নিয়ে এসেছেন। ক্রেতার চাহিদা থাকায় মেলা শুরু হওয়ার ২ ঘণ্টার মধ্যে তিনি ৩০ হাজার টাকা শুঁটকি মাছ বিক্রি করেছেন। বেচাকেনা ভালো হওয়ায় খুশি তিনি।


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শুঁটকি ব্যবসায়ী নিখিল দাস জানান, শুঁটকি কবে আসবে আগে থেকে প্রস্তুতি নেই। এ জন্যে বড় বড় মাছগুলো সংগ্রহ করে রাখি শুঁটকি করার জন্য। ক্রেতারা প্রচুর শুঁটকি কেনেন, তাই মেলাতে বড় মাছের শুঁটকি নিয়ে এসেছি। বেচাকেনা ভালো হওয়ায় বেশি লাভের আশা করছি।


আরও পড়ুন: কুয়াকাটায় প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত শুঁটকি যাচ্ছে বিদেশেও


শুঁটকির ক্রেতা বিহাদ আলী জানান, মেলায় এসে তিনি ৫/৬ হাজার শুঁটকি কিনেছেন। কারণ আত্মীয়-স্বজনসহ বিভিন্ন জায়গায় শুঁটকি পাঠাতে হবে। পছন্দের শুঁটকি মাছ পেয়ে অনেকটা খুশি তিনি।


মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য ওহাব আলী জানান, চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ থেকে ব্যবসায়ীরা শুঁটকির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। এর মধ্যে বোয়াল, গজার, শোল, বাইন, পুঁটি, টাকি, কাইক্কা ও টেংরাসহ দেশীয় প্রজাতির মাছের তৈরি শুঁটকিই বেশি পাওয়া যাচ্ছে।


এ দিকে শুঁটকি মেলায় শুঁটকি ছাড়াও বিক্রি হচ্ছে স্থানীয় কুমারদের হাতের তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কলস, থালা,বাটি, পুতুল ও প্রদীপসহ অন্যান্য সামগ্রী। এ ছাড়া মেলাটি সম্পূর্ণ ইজারা মুক্ত। দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ীরা যাতে হয়রানির শিকার না হন; সে ব্যাপারেও কঠোর নজরদারি করা হয় বলে জানান স্থানীয়রা।


মেলা পরিচালনা কমিটির তথ্য মতে, প্রতিদিন মেলায় ৫০ লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি হয়। 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন