এবার চোখ রাঙাচ্ছে জিকা ভাইরাস, সতর্ক থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

৪ সপ্তাহ আগে
দেশে ফের চোখ রাঙাচ্ছে এডিস মশাবাহিত জিকা ভাইরাস। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কয়েকজনের দেহে পাওয়া গেছে এই ভাইরাসের নমুনা। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ বা আইসিডিডিআর,বি থেকে জানা গেছে এই তথ্য।

এডিস মশাবাহিত অন্যান্য ভাইরাস ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার তুলনায় এই সংক্রমণের হার দেশে এখনও অনেক কম হলেও, এ ব্যাপারে এখন থেকেই সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য এডিস মশার বিস্তার রোধ করার ওপরে গুরুত্ব দিয়েছেন তারা।


জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের গুলেনবারি সিনড্রোমে (জিবিএস) আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর ফলে তারা চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তবে জিকা ভাইরাস সবচেয়ে বেশি হুমকি সৃষ্টি করে গর্ভবতী মা ও তার অনাগত সন্তানের ওপর। বিশেষ করে গর্ভবতী মা জিকায় সংক্রমিত হলে গর্ভের সন্তানের ‘মাইক্রোসেফালি’ নামে এক ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এর ফলে শিশুর মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশ না হয়ে জন্মের পর তাদের মাথা স্বাভাবিক আকৃতির থেকে অনেকটাই ছোট হয়। পাশাপাশি তাদের নানা ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে।


ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো এই জিকা ভাইরাসের সংক্রমণও এডিস মশার মাধ্যমেই ছড়ায়। জিকার প্রধানত দুটি ধরন রয়েছে: একটি এশিয়ান এবং অপরটি আফ্রিকান। ঢাকায় এখন পর্যন্ত এশিয়ান ধরনের জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআর,বি। 

 

তবে বাংলাদেশে এডিস মশাবাহিত জিকা রোগের সংক্রমণ এবারই প্রথম নয়। দেশে প্রথমবারের মতো জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয় ২০১৪ সালে। রক্ষিত রক্তের নমুনা থেকে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছিলো বলে তখন জানানো হয়েছিলো আইইডিসিআরের তরফে।


বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে ১৯৪৭ সালে সর্বপ্রথম আফ্রিকার উগান্ডার জিকা অঞ্চলে অবস্থিত বনাঞ্চলের বানরের মধ্যে শনাক্ত হয় এই ভাইরাস। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে উগান্ডা ও তানজানিয়াতেও মানুষের মাঝে এই রোগের সংক্রমণ ঘটে। এরপর ষাট থেকে আশির দশকের মধ্যে রোগটি আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তবে বছর খানেক আগে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস সংক্রমণ।  

 

২০১৬ সালে ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলাসহ কয়েকটি দেশে বেড়ে যায় স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট আকারের মাথাধারী নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার হার। এ অবস্থায় গর্ভবতী নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে জিকা আতঙ্ক। অনেক জিকা আক্রান্ত গর্ভবতী নারী প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্মদান এড়াতে বেছে নেন গর্ভপাতের মতো বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত। 


জিকা ভাইরাসের লক্ষ্মণ ও সংক্রমণের ব্যাপারে আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে বাকি ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার তিন থেকে বারো দিনের মধ্যে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা যায় এবং সেগুলো দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগটি নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। 

 

আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়, জিকা আক্রান্ত কোন দেশ থেকে ফিরে আসার ১৪ দিনের মধ্যে কোন ব্যক্তির শরীরে স্বল্প মাত্রার জ্বর এবং চামড়ার লালচে দানার ছোপ বা র‌্যাশ এবং সাথে মাথাব্যথা, চোখ লাল হওয়া, মাংসপেশীতে ব্যথা, গিটে গিটে ব্যথা হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিলে তার জিকা সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।

 

আরও পড়ুন: ঢাকায় জিকা ভাইরাস রোগী শনাক্ত


মূলত জিকা আক্রান্ত এডিস ইজিপ্টাই অথবা এডিস অ্যালবুপিক্টাস মশার কামড়ের মাধ্যমেই জিকা ছড়িয়ে থাকে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। এ ধরনের মশা সাধারণত দিনের বেলা (ভোরবেলা অথবা সন্ধ্যার সময়) কামড়ায়।


আক্রান্ত পুরুষ রোগীর সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সংসর্গের মাধ্যমেও পুরুষ হতে নারীদের মধ্যে ছড়াতে পারে এই রোগ। পাশাপাশি গর্ভবতী নারীরা গর্ভ ধারণের প্রথম তিন মাসের মধ্যে জিকায় আক্রান্ত হলে তার গর্ভের সন্তানও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। পাশাপাশি জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করলেও এই রোগ সংক্রমিত হতে পারে।


আইইডিসিআর জানিয়েছে, জিকার কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, এর চিকিৎসা উপসর্গভিত্তিক। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে, জ্বর ও ব্যথার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খেতে হবে। রোগীর অবস্থার অবনতি হলে কাছের সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে বা রোগীকে ভর্তি করাতে হবে।


জিকা সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায় হিসেবে আইইডিসিআর জানিয়েছে, এই রোগের সংক্রমণ প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো ব্যক্তিগতভাবে সচেতন থাকা। যেহেতু মশার কামড় থেকেই জিকার সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে; তাই মশা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলাই জিকা প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায়। এজন্য শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখা, ঘরবাড়ির জানালায় নেট লাগানো, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা, ইত্যাদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই সবচেয়ে উত্তম।


এছাড়া আবাসস্থল ও এর আশপাশের মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করার পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে যেন বাসার আশপাশে ফেলানো মাটির পাত্র, কলসি, বালতি, ড্রাম, ডাবের খোসা, ইত্যাদি যে সব স্থানে পানি জমতে না পারে।


যেসব দেশের জিকার সংক্রমণ বেশি, সেই দেশগুলোতে ভ্রমণের সময়ে সতর্কতা অবলম্বেনেরও পরামর্শ দিয়েছে আইইডিসিআর। বিশেষ করে এসব দেশ ভ্রমণের সময় মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া গর্ভবতী নারীদের জিকা সংক্রমণ আক্রান্ত দেশগুলো ভ্রমণ পরিহারেরও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।


দেশে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপারে বুধবার (২৭ নভেম্বর) আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন সময় সংবাদকে বলেন, জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আমরা পাচ্ছি, তবে তা ডেঙ্গু কিংবা চিকুনগুনিয়ার থেকে কম। তবে এটা গর্ভবতী নারীদের জন্য বিপজ্জনক। কারণ যদি গর্ভবতী নারীরা জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হন তবে তাদের গর্ভের বাচ্চার এতে নানা রকম সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। অনেক সময় মারাও যেতে পারে। আর বয়স্কদের ক্ষেত্রে তাদের গুলেবারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

 

অধ্যাপক তাহমিনা বলেন, তবে আমাদের দেশে এই সংক্রমণ বিপদজনক অবস্থায় না পৌঁছালেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য যে কোন ধরনের জ্বরে আক্রান্ত হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে দেশে জিকা ভাইরাস শনাক্ত করার পরীক্ষা সুবিধার অপ্রতুলতা রয়েছে বলে স্বীকার করেন আইইডিসিআরের পরিচালক। তাদের প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত ছয় জনের শরীরে জিকা ভাইরাস শনাক্তের কথা জানান তিনি।


অপরদিকে আইসিডিডিআর,বি’র ইনফেকশাস ডিজিজ বিভাগের বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম সময় সংবাদকে বলেন, এখন পর্যন্ত এ বছর চারজনকে জিকা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের সবাইকে অক্টোবর মাসে শনাক্ত করা হয়েছে। আর গত বছর শনাক্ত হন ৫ জন।


তাদের ব্যাপারে ড. শফিউল বলেন, ‘গত বছরের আক্রান্তদের মধ্যে আমরা জিকা ভাইরাসের এশিয়ান ভ্যারিয়ান্টের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পেরেছিলাম।  এ বছর যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদেরটা এখনও আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছি, পরীক্ষার পর জানা যাবে এগুলো কোন ভ্যারিয়ান্টের।’


গর্ভবতী নারীদের ওপর জিকা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, গর্ভবতী নারীদের যারা এই রোগে আক্রান্ত হন তাদের শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ সঠিকভাবে হয় না। 


এই মুহূর্তে জিকা সংক্রমণ নিয়ে খুব একটা আশঙ্কা না থাকলেও চিকুনগুনিয়ার বিস্তার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই বিজ্ঞানী। পাশাপাশি যেহেতু ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়া একই মশা অর্থাৎ এডিস মশা থেকে ছড়ায়, তাই এডিস মশার বিস্তার রোধ করার ব্যাপারেই বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা জানান তিনি।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন