ইসলামি ইতিহাসে হজের সূচনা

২ সপ্তাহ আগে
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো হজ। এই হজ পালন করার জন্য প্রতিবছর সারাবিশ্ব থেকে মানুষ সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনায় একত্রিত হন। উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন ও সারাজীবনে করা সব গোনাহ থেকে মুক্ত হওয়া। মহিমান্বিত এই হজ কি শুধু এই উম্মতের ওপর ফরজ হয়েছে নাকি এর আগেও ছিলো। কিভাবে এই হজের সূচনা হয়েছিলো আজ আমরা তাই জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

কাবা ঘরের সূচনা

 

হজের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো পবিত্র কাবা ঘর। যা মক্কা নগরিতে অবস্থিত। মক্কায় পৌঁছে এটাকে ঘিরে সাতবার প্রদক্ষিণ করতে হয় যাকে তাওয়াফ বলা হয়। হজের শেষেও এখানে তাওয়াফ করতে হয়। এই কাবা ঘর সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন মাজিদে বলেছেন,

 

إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِّلْعَالَمِينَ ‘নিঃসন্দেহে প্রথম ঘর যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছিলো, তাতো মক্কায়, যা বরকতময় এবং সারা জাহানের জন্য পথপ্রদর্শক।’ (সুরা ইমরান ৯৬)।

 

পবিত্র কাবা ঘর কখন নির্মিত হয়েছিল এ নিয়ে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তাআলার নির্দেশে ফেরেশতারাই সর্বপ্রথম কাবাঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। 

 

আরও পড়ুন: হজের যে পরিভাষাগুলো জানা জরুরি

 

হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হযরত হাওয়া আলাইহিস সালামের পৃথিবীতে মিলন হলে তারা উভয়ে আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ইবাদতের জন্য একটি মসজিদ হযরত আদম আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাঁদের দোয়া কবুল করেন এবং বাইতুল মামুরের আকৃতিতে ঠিক তার নিচে পৃথিবীতে পবিত্র কাবাঘর স্থাপন করেন।

 

ইবরাহিম আলাইহিস সালামের যুগে হজ


আদম আলাইহিস সালামের যুগে কাবা নির্মিত হলেও নুহ আলাইহিস সালামের যুগে হওয়া মহাপ্লাবনে তা ভেঙে যায়। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও ইসমাইল আলাইহিস সালাম তা একই স্থানে পুনর্নির্মাণ করেন। এরপর আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে জিবরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে হজের পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। তারপর তারা সে অনুযায়ী হজ পালন করেন।

 

একদিন ইবরাহিম আলাইহিস সালাম স্বপ্নের মাধ্যমে তার প্রিয়পুত্রকে জবাই করার জন্য আদিষ্ট হন। ইসমাইল আলাইহিস সালামকে তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। পরে তাকে জবেহ করার চেষ্টা করে হলে আল্লাহ তাআলা তার কুরবানিকে কবুল করে নেন। এ ব্যাপারে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে,

 

অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন, ‘হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, এখন বল, তোমার অভিমত কী? সে বলল, ‘হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন। (সুরা সাফফাত ১০২)

 

কোরবানির স্থলে যাওয়ার সময় শয়তান যখন ইসমাইল আলাইহিস সালামকে প্ররচনা করার চেষ্টা করে তখন তিনি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করেন। তিন জায়গায় এই পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।

 

এর আগে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে যখন ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তার স্ত্রী হাজেরা আলাইহাস সালাম ও শিশু পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামকে মক্কায় রেখে যান তখন সেখানে কোনো মানুষ, গাছপালা ও খাবার-পানি ছিলো না। হাজেরা আলাইহাস সালাম তখন পানির খোঁজে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে দৌড় দিয়েছিলেন।

 

আল্লাহ তাআলা হাজেরা, ইবরাহিম ও ইসমাইল আলাইহিমুস সালামের এই চেষ্টা ও কোরবানিকে এতই কবুল করেছেন যে তাদের প্রতিটি কাজকে হজের কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন।


প্রাক ইসলামি যুগে হজ


হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের আগেও আরবরা হজ পালন করতো। ইবারাহীম আলাইহিস সালামের যুগ থেকেই এই হজের প্রচলন চলে আসে। এজন্য আরবরা হজের মাসগুলোতে তথা শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ এবং হজ পরবর্তী শাওয়াল মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ করতো না। কাবা ঘরকে কেন্দ্র করে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতো এবং হজের বিভিন্ন রীতি পালন করতো যা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দেখানো হজ থেকে ভিন্ন ও বিকৃত ছিলো। তারা সাফা-মারওয়া পাহাড়ে এবং কাবা ঘরে মূর্তি রেখে পূজা করতো। উলঙ্গ হয়ে কাবা ঘর তাওয়াফ করতো।


মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে হজ

 


বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী আল্লাহ তাআলা এই উম্মতি মুহাম্মদির ওপর নবম হিজরিতে হজ ফরজ করেন। তিনি বলেন,

 

وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا উক্ত ঘর পর্যন্ত যার পৌঁছার সামর্থ্য আছে আল্লাহর জন্য তার ওপর হজ করা আবশ্যক। (সুরা আলে ইমরান ৯৭)


এ আয়াতের ভিত্তিতে হজ ফরজ হয়। এ আয়াত নাজিলের পর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবুবকর (রাযি.)-কে আমির নিযুক্ত করে হজ পালন করার জন্য পাঠান। সেবার ৩০০ জন সাহাবি হজ পালন করেছিলেন। এই হজের সময় সূরা তাওবাহ অবতীর্ণ হয়। ওই সুরায় মুশরিকদের সাথে থাকা শান্তি চুক্তি তারা ভঙ্গ করতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক করেন এবং নির্দেশ দেন আজকের পর থেকে মুশরিকরা হারাম শরিফের সীমানায় প্রবেশ করতে পারবে না এবং কেউ যেন হারাম মাসগুলোতে যুদ্ধের আশঙ্কা না করে।


তাই রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী (রাযি.)-কে ডাকলেন এবং বললেন, সূরা তাওবায় হজ বিষয়ে যে বিধান ঘোষণা করা হয়েছে, তা মুসলিমদের জানিয়ে দাও। তখন আলী (রাযি.) মিনায় সমবেত মুসলিমদের মধ্যে মুশরিকদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দেন।


আল্লাহর রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে সেদিন তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেন, 

 

কোনো কাফের জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আজকের পর কোনো মুশরিক হজ করতে পারবে না এবং বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করতে পারবে না। মুশরিকদের সাথে মুসলিমদের শান্তিচুক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত বহাল ছিল যতক্ষণ তারা তা ভঙ্গ করেনি।


 

এরপর দশম হিজরিতে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে হজ পালন করেন। তখন লক্ষাধিক সাহাবি হজে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে মত পাওয়া যায়। এটাই ছিল রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক পালনকৃত একমাত্র হজ। হজ থেকে ফিরে তিনি ইন্তেকাল করেন। এ হজে আরাফাতের ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তাকে বলা হয় বিদায় হজের ভাষণ।

 

আরও পড়ুন: দেনমোহরের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ পরিমাণ
 


বিদায় হজের ভাষণে তিনি অন্যায়ভাবে মানুষের রক্তপাত বন্ধ, সুদের কুফল, বর্ণবৈষম্যের ভয়াবহতা, স্বজনপ্রীতির বিরূপ প্রভাব, জাহেলি যুগের মানসিকতা পরিহার করার বিষয়ে জোরালো নির্দেশনা প্রদান করেন। নারীর অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের মর্যাদার বিষয় তুলে ধরেন।

 

সাম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকের অধিকার রক্ষা, পরমতসহিষ্ণু হওয়া, সর্বোপরি মানব সভ্যতাবিরোধী সব বর্বরতা পরিহার করে একনিষ্ঠভাবে কোরআন-সুন্নাহ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন