আমি আর আমার ভাই যখন ক্যাফের কাছে পৌঁছে গেছি, তখনই পরিচিত একটা শব্দ কানে এল— একটি বিস্ফোরণের গর্জন। ইসরাইলি একটি ড্রোন টুইক্স ক্যাফের প্রবেশপথে আঘাত হেনেছিল।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! মনে হলো— এই তো শেষ, এবার আমার পালা! আমি আর এই যুদ্ধ থেকে বাঁচব না!
তিনজন নিহত হয়েছিলেন। আরও কয়েকজন আহত হন। আমি আর আমার ভাই যদি পরিবারের তাঁবু থেকে কয়েক মিনিট আগে বের হতাম, আমরাও হয়তো নিহতদের মধ্যে থাকতাম।
খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই আমার পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কে পড়ে গেল। তারা বারবার আমাদের ফোন করছিল, কিন্তু সিগন্যাল খুব দুর্বল ছিল, তাই যোগাযোগ করতে পারছিল না। অবশেষে আমরা তাঁবুতে ফিরে আসার পরই মা শান্ত হন।
আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এ কেমন “যুদ্ধবিরতি”? ভয় নয়, বরং ক্ষোভেই মনটা ভরে গেল।
যখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো এবং বিদেশি নেতারা বললেন যে, ‘যুদ্ধ শেষ’ তখন আমাদের অনেকেই আশায় বুক বাধলাম। ভাবলাম— এবার হয়তো বিস্ফোরণ থেমে যাবে, আমরা হয়তো ভয় ছাড়াই আমাদের বিধ্বস্ত জীবনটা আবার গড়ে তুলতে পারব।
কিন্তু ইসরাইলি দখলের অধীনে এমন কোনো আশা নেই। সহিংসতা কখনো সত্যিই শেষ হয় না। সেদিন, যখন ইসরাইলি সেনারা টুইক্স ক্যাফেতে বোমা ফেলেছিল, তখন তারা গাজা উপত্যকার আরও ডজন ডজন স্থানে হামলা চালায়— কমপক্ষে ৪৫ জন নিহত হন এবং আরও অনেকেই আহত হন।
আরও পড়ুন: অস্ত্র ছাড়তে রাজি হামাস, তবে দিলো শর্ত
এটি ছিল যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিন। হতাহতের ঘটনা ছাড়া একটা দিনও পার হয়নি; ইসরাইল এখনো প্রতিদিন মানুষ হত্যা করছে। তথাকথিত এই যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
তাদের মধ্যে ছিলেন ‘আবু শাবান’ পরিবারের ১১ জন সদস্য। এই হত্যাযজ্ঞটি ঘটেছিল ১৮ অক্টোবর, ব্যাপক বোমাবর্ষণের আগের দিন। আবু শাবান পরিবারটি গাজা সিটির জেইতুন পাড়ায় নিজেদের বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করছিল। তারা সবাই একই গাড়িতে ছিলেন।
একটি ইসরাইলি বোমা মুহূর্তেই শেষ করে দেয় চারজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জীবন— সুফিয়ান, সামার, ইহাব এবং রান্দা। সঙ্গে সাতটি শিশুর জীবনও কেড়ে নেয়— করাম (১০), আনাস (৮), নেসমা (১২), নাসের (১৩), জুমানা (১০), ইব্রাহিম (৬) এবং মোহাম্মদ (৫)।
এটাই হলো ইসরায়েলের ভাষায় “যুদ্ধবিরতি”!
রোববার, যখন ব্যাপক বোমাবর্ষণ শুরু হলো, তখন পুরো গাজা উপত্যকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। বিস্ফোরণ চলতে থাকায় মানুষ দৌড়ে বাজারে গেল, যতটা সম্ভব খাবার কিনে রাখার জন্য— যুদ্ধ ও অনাহারের নতুন অধ্যায়ের প্রস্তুতি নিতে।
সেই দৃশ্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল— চারদিকে বোমা পড়ছে, অথচ মানুষের চিন্তা শুধু একটাই— খাবার। মনে হয় আমরা চিরদিনের মতো সেই নিরাপত্তাবোধের অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছি যে, আগামীকাল টেবিলে খাবার থাকবে।
হ্যাঁ, আমাদের এখনো নিজেদের খাবার কিনেই খেতে হচ্ছে। কারণ, ইসরাইল শুধু বোমা মেরে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে না, বরং যে ত্রাণ ঢোকার অনুমতি দেওয়ার কথা ছিল সেটিও আটকে দিচ্ছে। প্রতিদিন অন্তত ৬০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় ঢোকার কথা ছিল। কিন্তু গাজা মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর (১১ অক্টোবর থেকে) এখন পর্যন্ত (২৬ অক্টোবর) মাত্র ৯৮৬টি ট্রাক প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির মাত্র ১৫ শতাংশ!
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানায়, তাদের মাত্র ৫৩০টি ট্রাক ঢুকতে পেরেছে। আর ইউএনআরডব্লিউএ-এর ৬,০০০ ট্রাক এখনো প্রবেশের অপেক্ষায় আছে— একটিও ঢুকতে পারেনি।
আরও পড়ুন: হামাসের বিরুদ্ধে ‘চুক্তি লঙ্ঘন’র অভিযোগ নেতানিয়াহুর
গতকাল ডব্লিউএফপি'র এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, গাজা সিটিতে এখনো কোনো বড় ত্রাণ কাফেলা প্রবেশ করতে পারেনি; ইসরাইল এখনো সংস্থাটিকে সালাহ আল-দ্বীন সড়ক ব্যবহার করার অনুমতি দিচ্ছে না। গাজার উত্তরাঞ্চলকে অনাহারে রাখার ইসরাইলি নীতি এখনো বহাল রয়েছে।
মিশরের সঙ্গে গাজার একমাত্র সংযোগ এবং বাইরের বিশ্বের দিকে যাওয়ার একমাত্র পথ ‘রাফাহ সীমান্ত’ এখনো বন্ধ। আমরা জানি না এটি আবার কবে খুলবে, কবে আহত হাজারো মানুষ চিকিৎসার জন্য পার হতে পারবে, কবে শিক্ষার্থীরা বিদেশে গিয়ে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে, কবে যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবারগুলো আবার একত্র হবে, আর কবে গাজাকে ভালোবাসা মানুষগুলো— যারা এতদিন ধরে ঘরে ফেরার অপেক্ষায়— অবশেষে ফিরে আসতে পারবে।
এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে— ইসরাইল এই “যুদ্ধবিরতি”কে একধরনের সুইচের মতো ব্যবহার করছে। যখন ইচ্ছে চালু করে, যখন ইচ্ছে বন্ধ করে দেয়। রোববার আমরা আবার ভয়াবহ বোমাবর্ষণের মধ্যে পড়লাম, আর সোমবারই আবার “যুদ্ধবিরতি” ঘোষণা করা হলো। যেন কিছুই হয়নি! যেন ৪৫ জন মানুষকে হত্যা করা হয়নি, কোনো ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়নি, কোনো পরিবার ভেঙে যায়নি!
আমাদের জীবনকে এতটা মূল্যহীন মনে করা ভীষণ বেদনাদায়ক। আরও ভয়াবহ লাগে এই ভেবে যে, ইসরাইল যেকোনো সময়, কোনো সতর্কতা বা অজুহাত ছাড়াই আবার গণহত্যা শুরু করতে পারে!
এই তথাকথিত যুদ্ধবিরতি আসলে একটি অন্তহীন যুদ্ধের ক্ষণিক বিরতি মাত্র— একটা নীরব মুহূর্ত, যা যে কোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। আমরা রক্তপিপাসু দখলদারের করুণার উপরই বেঁচে আছি, যতদিন না বিশ্ব আমাদের বাঁচার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং তা রক্ষায় বাস্তব পদক্ষেপ নেয়।
ততদিন পর্যন্ত আমরা ইসরাইলের অবিরাম হত্যাযজ্ঞের খবরের শিরোনামে কেবলই ‘সংখ্যা’ হয়ে থাকব।
[আল-জাজিরা থেকে অনুদিত]
লেখক: সারা আওয়াদ
ইংরেজি সাহিত্যের একজন শিক্ষার্থী, লেখক এবং গল্পকার। মানবজীবনের অভিজ্ঞতা ও সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরার প্রতি গভীর অনুরাগ থেকেই তিনি লেখালেখি করেন। তার লেখায় প্রতিফলিত হয় যুদ্ধের মাঝেও মানুষের ‘অদম্য টিকে থাকা, পরিচয়ের সংগ্রাম এবং আশার দীপ্তি‘।
]]>
৩ সপ্তাহ আগে
৩







Bengali (BD) ·
English (US) ·